এ নিয়ে প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে বেশ কয়েকজন পরীক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা।
বোর্ড থেকে জানানো হয়েছে, ২০২৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র (বিষয় কোড-১০৮), উচ্চতর গণিত (বিষয় কোড-১২৬) এবং বাংলা দ্বিতীয় পত্রের (বিষয় কোড-১০২) খাতা মূল্যায়নে অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে।
এ নিয়ে অভিযুক্ত পরীক্ষকরা হলেন- রাজধানীর ডেমরার রোকেয়া আহসান কলেজের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক মুরছানা আক্তার, মোহাম্মদপুরের সেন্ট যোসেফস হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের উচ্চতর গণিতের শিক্ষক মহসীন আলামীন, যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ের পরীক্ষক মো. সাখাওয়াত হোসাইন আকন, রাজবাড়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পরীক্ষক সমীরময় মন্ডল, নবাবগঞ্জের মুন্সীনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিক এবং গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার আনসার ভিডিপি স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা বিষয়ের প্রভাষক মো. রাকিবুল হাসান।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বোর্ড পরীক্ষার খাতা নিয়ে নিয়মবহির্ভূত যে ঘটনা ঘটছে তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মজা, বিদ্রুপ ও হাস্যরসের উপস্থাপন পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলছে। টিকটক, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম ঘাঁটলেই দেখা যাচ্ছে- খাতা কাটছেন শিক্ষার্থীরাই, কেউ আবার খাতা হাতে বসে খিচুড়ি, লুচি, পরোটা খাচ্ছেন। যেখানে একপাশে রাখা খাতা, আরেক পাশে চাটনি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা নিজেরাই খাতার ওএমআর অংশ (বৃত্ত) পূরণ করছেন। কোথাও কোথাও একাধিক শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে বসে খাতা পূরণ করতে দেখা গেছে। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবি শেয়ার করে এক শিক্ষার্থী ক্যাপশন দিয়েছেন- ‘বোর্ডের খাতা কাটছে টিকটকার’। আরেকজন লিখেছেন– ‘তোমাদের খাতা এখন আমাদের হাতে’। কেউ কেউ আবার ফল নিয়েও মজা করে লিখেছেন- ‘কে ভাই এইটা ৯২ পাইছে’। এসব পোস্ট এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যা নিয়ে বোর্ড পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে বিশ্বাসযোগ্যতা ও সার্বিক মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
এ অবস্থায় উদ্বেগ, হতাশা আর অনিশ্চয়তায় ভুগছেন ২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষার খাতার গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর তারা প্রশ্ন তুলছেন কেন্দ্রীয় পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের যথাযথ পদ্ধতি ও বোর্ডের নজরদারি নিয়ে।
এইচএসসি পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে এমন অনিয়ম নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন অভিভাবকরাও।
বিষয়টি নিয়ে নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর একটি সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক বলেন, বর্তমানে পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন নিয়ে যেসব অনিয়মের খবর আসছে তা শুধু হতাশাজনকই নয়, এগুলো শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা টালমাটাল করে দিচ্ছে। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি দেখেছি, অনেক সময় খাতা নেওয়ার তাড়াহুড়া, মূল্যায়নে সময়ের স্বল্পতা অথবা আর্থিক লাভের আশায় কিছু শিক্ষক নিজের খাতা অন্যকে দিয়ে মূল্যায়ন করিয়ে থাকেন। আবার অনেক সময় যারা খাতা মূল্যায়নের যোগ্য নন, তারাও বিভিন্ন প্রভাব খাটিয়ে দায়িত্ব পেয়ে যান। প্রকৃত মেধাবীদের ফলে এর প্রভাব পড়ে, আবার দুর্বল শিক্ষার্থীরা বাড়তি নম্বর পেয়ে যায়। এতে শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাসে ধাক্কা লাগে, অনেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।
তিনি আরও বলেন, এ সমস্যার সমাধানে বোর্ডগুলোর মনিটরিং জোরদার করতে হবে। খাতা কোন শিক্ষক নিচ্ছেন, কে মূল্যায়ন করছেন, সেটা একটি ডিজিটাল ট্র্যাকিং সিস্টেমে রাখতে হবে। মূল্যায়নের পর ৫-১০ শতাংশ খাতা রিভিউ করার একটি স্বতন্ত্র টিম থাকতে হবে। প্রয়োজনে একটি ‘র্যান্ডম অডিট’ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে, যেখানে বাছাই করা খাতা দ্বিতীয়বার মূল্যায়ন হবে।
অন্যদিকে শিক্ষা বোর্ড বলছে, শিক্ষার্থীদের দিয়ে উত্তরপত্র পূরণ করানো শুধু গোপনীয়তার লঙ্ঘনই নয়, বরং তা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেননা, পাবলিক পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নের নির্ধারিত প্রক্রিয়া রয়েছে। কেবল অনুমোদিত পরীক্ষকই খাতা খোলার ও মূল্যায়ন করার অধিকার রাখেন। প্রতিটি খাতা বোর্ড থেকে সিলগালা অবস্থায় নির্ধারিত কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া হয় এবং খোলা হয় নির্ধারিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে। এমসিকিউ অংশের বৃত্ত পূরণও পরীক্ষকের দায়িত্ব। সেখানে কোনো শিক্ষার্থী, এমনকি সহকারী শিক্ষকও যুক্ত হতে পারেন না।
আবার নিয়ম অনুসারে, উত্তরপত্রের ওপর কোনোভাবেই শিক্ষার্থীর রোল নম্বর বা নাম থাকে না। এতে থাকে একটি নির্দিষ্ট কোড, যাতে পরিচয় গোপন থাকে এবং পক্ষপাতের সুযোগ না থাকে। খাতা মূল্যায়নের পর পরীক্ষক তা প্রধান পরীক্ষকের মাধ্যমে বোর্ডে ফেরত পাঠান। এই পুরো প্রক্রিয়া অত্যন্ত গোপনীয়, কেন্দ্রীয়ভাবে নির্ধারিত এবং নির্দিষ্ট নির্দেশিকা অনুযায়ী পরিচালিত হয়।
শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, সম্প্রতি একের পর এক খাতা মূল্যায়নে অনিয়মের ঘটনায় বোর্ড উদ্বিগ্ন। আগে কয়েকটি অনিয়মের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এবারও জিরো টলারেন্স নীতির আওতায় তদন্ত হচ্ছে। চিহ্নিত অপরাধীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা, চাকরিচ্যুতি কিংবা স্থায়ীভাবে খাতা মূল্যায়নের দায়িত্ব থেকে বাদ দেওয়ার মতো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।