কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। দেশ স্বনির্ভর হবে, উপকৃত হবে গোটা জাতি। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে যে কৃষক আমাদের খাদ্যের যোগান দেন, সেই কৃষকের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমনই এক ভয়াবহ প্রতারণার চিত্র।ডিলারদের দোকানে সাঁটানো রয়েছে সারের সরকারি মূল্যতালিকা। তবে তা নিছক লোক দেখানো। কোনো সারই সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করেন না তারা। সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকা দেশে উৎপাদিত টিএসপির দাম এখানে দ্বিগুণ। প্রশাসনের তদারকিও নেই। সারের বাজারের এই চিত্র টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার প্রতিটি বাজারে।স্থানীয়রা জানান, উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চল বিশেষ করে সাগরদীঘি, গারোবাজার, ধলাপাড়া এলাকা কলা, ড্রাগন, পেঁপে,হলুদ ও সবজি চাষের জন্য বিখ্যাত। এ ধরনের ফসলের জন্য এখানে সবচেয়ে বেশি চাহিদা টিএসপি সারের। কারণ, টিএসপি মাটিতে ফসফরাসের ঘাটতি পূরণ করে গাছের শিকড় মজবুত করে। সময়মতো ফুল ফোটা, ফসল পরিপক্ব হওয়া এবং গুণগত মানের জন্যও এটি অত্যন্ত জরুরি।কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আমদানিকৃত টিএসপি সারে ফলন আশানুরূপ হয় না। এ কারণে তারা খোঁজেন দেশে উৎপাদিত টিএসপি। তবে এটি পাওয়া কঠিন। পাওয়া গেলেও দিতে হয় দ্বিগুণ দাম। চাহিদা বেশি থাকার সুযোগটিই নেন ডিলাররা। অন্য সারও সরকার নির্ধারিত দামে পাওয়া যায় না।উপজেলায় বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) ডিলারের সংখ্যা ১৮ এবং খুচরা সার বিক্রেতা ১২৬ জন। সরকার নির্ধারিত সারের দাম- ইউরিয়া ও টিএসপি ৫০ কেজির প্রতি বস্তা ১ হাজার ৩৫০ টাকা এবং এমওপি ১ হাজার টাকা।উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষকেরা জানান, কোথাও এ দামে সার কিনতে পারেন না তারা। বর্তমানে দেশি টিএসপি কিনতে তাদের গুনতে হচ্ছে ২৬০০ থেকে ২৮০০ টাকা। অন্য সারের বস্তায়ও ১০০ থেকে ২০০ টাকা বেশি দিতে হয়।স্থানীয় দুইজন ডিলার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোণার হাওর অঞ্চলে টিএসপির চাহিদা খুবই কম। কিন্তু দেশি টিএসপি ওই এলাকাগুলোতে বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেখানকার ডিলারদের মাধ্যমে এখানে কেউ কেউ নিয়ে এসে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করেন।দুলালিয়া গ্রামের কৃষক আব্দুর রহিম বলেন, এ বছর ২০ একর জমিতে কলা চাষ করেছি। প্রতি মাসে ৪ লাখ টাকার সার দিতে হয়। এরমধ্যে টিএসপি কিনতে হচ্ছে বস্তাপ্রতি ২ হাজার ৬০০ টাকায়। অন্যান্য সারের দামও বেশি।গারোবাজারের মুরাইদ গ্রামের কলা চাষি রাজিবুল ইসলাম জানান, ডিলারের কাছে সরাসরি গেলে চাহিদা অনুযায়ী সার পাওয়া যায় না। কিন্তু দাম বেশি দিলে কিছু দোকানে কখনোই সারের ঘাটতি হয় না। এছাড়া দেশীয় টিএসপি, এমওপি ও ইউরিয়া সার না পাওয়ায় বিএডিসির মাধ্যমে আমদানি করা সার ব্যবহার করতে হচ্ছে। তবে এতে কাঙ্ক্ষিত ফসল ফলে না।বিষয়টি যাচাই করতে গারোবাজারে সারের সবচেয়ে বড় দোকান মেসার্স রুনি ট্রেডার্সে গিয়ে দোকানের মালিক আব্দুল বাছেদ খানের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, দেশে উৎপাদিত টিএসপি (টিএসপি কমপ্লেক্স) নেই; আমদানির টিএসপি আছে। তবে দাম হাঁকান ১ হাজার ৪৫০ টাকা বস্তা। কত বস্তা আছে জানতে চাইলে বলেন, ১০০ বস্তার ওপরে আছে।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারিভাবে ডিলারদের মধ্যে প্রায় একই পরিমাণ সার বণ্টন হয়। একাধিক ডিলারের তথ্যমতে, অক্টোবরে তারা ৩৮০ বস্তা ইউরিয়া, টিএসপি ৬১, এমওপি ৭২ এবং ডিএপি সার পেয়েছেন ২০০ বস্তা করে। নভেম্বরের বরাদ্দ এখনো আসেনি। সেই হিসেবে আব্দুল বাছেদের কাছে ১০০ বস্তা টিএসপি থাকার কথা নয়।এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি দাবি করেন, নভেম্বরে ৮০ বস্তা টিএসপি পেয়েছেন। কবে পেয়েছেন জানতে চাইলে বলেন, রোববার। অথচ ১০০ বস্তা টিএসপি থাকার কথা তিনি প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছিলেন। এ সময় সারের বাড়তি দাম নেয়ার কথাও অস্বীকার করেন তিনি।স্থানীয় কৃষকেরা জানান, দেশে উৎপাদিত টিএসপি সার বাছেদ খানের কাছে আছে। তিনি এই সার সবার কাছে বিক্রি করেন না। নির্দিষ্ট কিছু কৃষককে চড়া দামে বিক্রি করে দেন। তিনি একজন অসাধু ব্যবসায়ী।উপজেলার সাগরদীঘি এলাকায় বড় চাষি আছেন ২০ থেকে ২৫ জন। তাদের একজন নাছির সিকদার। তিনি বলেন, ডিলাররা এভাবে প্রতি মাসে স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে ন্যূনতম ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। কৃষক বাঁচাতে অবশ্যই সরকারের এদিকে নজর দেওয়া উচিত।সাগরদীঘি বাজারের বিসিআইসি সারের ডিলার আশিষ সাহা দাবি করেন, দেশি টিএসপি অনেকদিন ধরে তারা বরাদ্দ পান না। আর তিনি সরকার নির্ধারিত দরেই সার বিক্রি করছেন।উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দিলশাদ জাহান বলেন, কৃষকেরা বেশি দামে সার কিনেছেন; এমন অভিযোগ পাইনি। দেশে উৎপাদিত টিএসপি সারের সরবরাহ রয়েছে। আর আমদানি করা সারে ফলন খারাপ হওয়ার অভিযোগ মাঠ পর্যায় থেকে পাইনি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই ল্যাব টেস্টে পাঠানো হবে।উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন ইসলাম বলেন, সার নিয়ে কোনো অভিযোগ পাইনি। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।