বিনোদন মানুষের আগ্রহের একটি কেন্দ্রবিন্দু। মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনের বিরক্তিকর রুটিন থেকে বের হয়ে নিজেকে অন্য এক জগতে নিয়ে যেতে চায়। পেতে চায় ভিন্ন রকম এক স্বাদ, যেখানে থাকবে না কোনো কাজের কিংবা পরিবারের চাপ এবং পাবে মানসিক প্রশান্তি

  এই বিনোদনের জন্য এক এক মানুষের পছন্দ এক এক ধরণের। কেউ বিনোদন খোঁজে তার প্রিয় গায়কের গানে, কেউ তার প্রিয় লেখকের লেখায়, কেউ মিশে যেতে চায় প্রকৃতির মাঝে, কেউ তার আপন মানুষের সাথে আড্ডায় বা তার প্রিয় দলের খেলায়। যাই হোক আমরা যদি বিনোদনকে এক কথায় বলতে চাই তাহলে বলতে হবে, বিনোদন এমন এক ধরণের কাজ যা দেখে, শ্রবণ করে, ধারণা করে বা নিজে সেই কাজ করে আনন্দ পায়। আমার মতে বিনোদন হলো এমন কাজ যা মানুষকে আনন্দ বা মজা দেয়ার পাশাপাশি তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে সহায়তা করে, তাই বিনোদন। বিনোদনের অনেক দিক রয়েছে। যেমন শরীর চর্চা, গল্পবলা, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, নাটক, কবিতা, বই, নৃত্য, কমিক নাটক, খেলাধুলা ইত্যাদি। বর্তমান সময়ে মানুষ কিছু বিষয়ে সিজনাল সমর্থক আবার কিছু বিষয়ে রেগুলার। যেমন আমরা অনেকেই নিয়মিত বই পড়ি কিন্তু কোনো উৎসবকে ঘিরে আমাদের সমর্থন সেই দিকে চলে যায়, এর সব থেকে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো “গ্রেটেস্ট শো অন দা আর্থ” বা ফুটবল বিশ্বকাপ। অন্যান্য দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও খেলাধুলা নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই বরং এবার ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে আমাদের উম্মাদনা অন্য যেকোনো বিশ্বকাপের তুলনায় একটু বেশী বলেই মনে হচ্ছে। আমাদের ব্যবসায়ী ভাইয়েরা এই বিশ্বকাপকে ঘিরে তাদের জার্সি ও পতাকা বিক্রয়ের সন্তুষ্টি দেখেই বুঝা যায় খেলাধুলার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের উম্মাদনা কেমন, এমন কি অনেক বিক্রেতা জানায়, তারা ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী জার্সি দিতে হিমশিম খাচ্ছে।


ওয়ার্ল্ড স্পোর্টস ২৪ এর সূত্র মতে, বর্তমান সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে ফুটবল, প্রায় ৪ বিলিয়ন বা ৪০০ কোটি সমর্থক রয়েছে এই খেলায়, এর থেকেও মজার বিষয় হলো যে পরিমাণ মানুষ ক্রিকেট এর ভক্ত তার চেয়ে বেশী মানুষ প্রায় ২.৫ বিলিয়ন মানুষ ফুটবল খেলে থাকেন। বিনোদনের কিছু নিয়ামক রয়েছে যা দর্শকের সন্তুষ্টি লাভে সহায়ক বা যে নিয়ামক সমূহ বিনোদনে থাকা খুবই জরুরী অথবা দর্শকমহলের উচিৎ এ সকল নিয়ামক তার বিনোদনে উপস্থিত আছে কিনা তা খুঁজে দেখা।‌ যেমন বিনোদনের বিষয় টি কতটা বাস্তবসম্মত, বিনোদনের ধরণ বর্তমান পরিস্থিতিকে কতখানি প্রভাবিত করে, এই বিনোদন আপনাকে আপনার জীবনের গুরুত্ব বুঝাতে সক্ষম কিনা, আপনি এই বিনোদন থেকে কি শিখতে পারলেন, নতুন কোন বিষয়টি আপনি জানতে পারলেন ইত্যাদি। সর্বোপরি বিনোদন হবে সেই সকল কাজ যা আপনার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে সহায়তা করবে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের উম্মাদনা এতোটাই বেশি যে, আমরা কোনো কিছু চিন্তা করতে চাই না, আমরা আবেগে ভেসেতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। হাজার ফুটের লম্বা পতাকা বানিয়ে রাস্তার পাশে ঝুলিয়ে রাখছি। জমি বিক্রি করে নিজ বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি পর্যন্ত পতাকা লাগানোর ঘটনাও ঘটাচ্ছি। কিন্তু দেশের মানুষ না খেয়ে শীতের রাতে রাস্তায় ঘুমাচ্ছে, বিকৃত পতাকা বানাচ্ছি আর অহংকার করছি কিন্তু পতাকার নামে যে অপমাননা করছি তার খবর কিন্তু কেউ রাখছি না। নিজ দলের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে বিশাল আকৃতির পতাকা টাঙ্গিয়েছি। কিন্তু আমার দেশের পতাকা সেখানে স্থান পায়নি, দলের সমর্থনে যা ইচ্ছে তাই বলছি এমনকি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ প্লেয়ারদের নিয়ে কটাক্ষ করতেও দ্বিধা করছি না।


এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে নষ্ট হচ্ছে অনেক ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব ও প্রিয়জনের সাথে গড়ে উঠা মধুর সম্পর্ক। দল যখন হেরে যায় তখন হয়তো ঘরবন্দি নয়তো মিথ্যে বা কাল্পনিক ফন্দি আড়তে থাকি। রাত বিরাতে এলাকায় আতশবাজি আর বিজয় মিছিল করছি। এতে করে এলাকাবাসীর যতই সমস্যা হোক তাতে আমার কিছু যায় আসেনা। আমরা এতোটাই আবেগি যে, দলের জন্য জীবন দিতেও দ্বিধা করিনা। আর্জেন্টিনা প্রথম ম্যাচ পরাজিত হওয়ার পর কুমিল্লায় একজন মারা যায়। কেভিন ডেভিস নামক ৬৬ বছর বয়সী এক ওয়েলস সমর্থক মারা যায়। পতাকা টাঙ্গাতে গিয়ে কক্সবাজারে ২ জন কিশোর নিহত হয়। কিছু দিন আগে নেত্রকোনার শামিম মিয়াঁ নামে ২৮ বছর বয়সের একজন হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায়। বিগত বছরগুলো বিবেচনা করলে দেখা যায় ১৯৬৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৩ শত ছাব্বিশ জন সমর্থক গাদাগাদি, হুড়োহুড়ি এবং পদদলিত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। এরমধ্যে সর্বাধিক করুণ ঘটনা টি ঘটে ১৯৬৪ সালে পেরুতে। যেখানে প্রায় ৩২০ জন মারা যায় এবং ২০০১ সালে ১২৬ জন ঘানায়। এছাড়াও চলতি বছরে ইন্দোনেশিয়ায় ১২৭ জন সমর্থক স্টেডিয়ামে পদপিষ্ট হয়ে মারা যায়। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সর্বপ্রথম আমাদের নিজেদেরকে সচেতন হতে হবে। আবাসিক এলাকার বাহিরে বিজয় উৎসব পালন করতে হবে। খেলার মধ্যে হার জিত অবশ্যই থাকবে এবং একথা মেনে নেয়ার মতো মানসিকতা থাকতে হবে। অতি আবেগি হওয়া যাবে না, কারো সাথে তর্কে জড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। সকল দলের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। বিনোদনকে ব্যবহার করে অন্যকে হেয় করা যাবে না। কাজ করার পূর্বে এর ফলাফল কি হতে পারে তা নিয়ে ভাবতে হবে। মানবিক মানসিকতা পোষন করতে হবে। দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ও দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা লালন করতে হবে। কোনক্রমে বিনোদন যেন ক্ষতির কারণ হতে না হয়, এই দিকটি বিশেষভাবে খেয়াল করতে হবে। মনে রাখতে হবে খেলা কেবল মাত্র একটি বিনোদন, আর বিনোদন আপনার জন্য, বিনোদনের জন্য আপনি নন।