২০০৪ সালে দুদক আইন হবার পর ২০১৩ ও ২০১৬ সালে এটি সংশোধন করা হয় এবং ২০০৭ সালে বিধিমালা প্রবর্তন করে ২০১৯ সালে তা সংশোধন করা হয়। সংশোধিত আইন ও বিধি দ্বারা বর্তমানে দুদক কাজ করে। বর্তমান সরকার টিআইবি এর নির্বাহী পরিচালক ডঃ ইফতেখারুজ্জামান কে প্রধান করে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন নামে একটি কমিশন গঠন করে।

দুদকের বর্তমান কার্যক্রম, বাধা, উত্তরণের উপায়।

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকৌশলী মোহাম্মদ কামরুল হাসান:


দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) হল বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন, নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতি প্রতিরোধে গঠিত একটি কমিশন। ২০০৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী দুর্নীতি দমন কমিশন গঠিত হয়। কমিশন গঠনের পূর্বে দুর্নীতি দমন ব্যুরো নামে এই প্রতিষ্ঠান একই ধরনের কাজ করত। ২০০৪ সালে দুদক আইন হবার পর ২০১৩ ও ২০১৬ সালে এটি সংশোধন করা হয় এবং ২০০৭ সালে বিধিমালা প্রবর্তন করে ২০১৯ সালে তা সংশোধন করা হয়। সংশোধিত আইন ও বিধি দ্বারা বর্তমানে দুদক কাজ করে। বর্তমান সরকার টিআইবি এর নির্বাহী পরিচালক ডঃ ইফতেখারুজ্জামান কে প্রধান করে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন নামে একটি কমিশন গঠন করে। ধারনা করা যায় এই কমিশন বর্তমানে দুদকে  প্রাক্টিসিং  আইন,বিধি, নিয়োগ, প্রেষণ, পদোন্নতি, অনুসন্ধান, তদন্ত সংক্রান্ত বিষয়গুলোর খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার প্রস্তাব করবে। ইতঃমধ্যে কমিটি অংশীজনদের সাথে মিটিং ও  আলোচনা করেছে; তবে সম্প্রতি পদত্যাগী বা সাবেক কোন কমিশনের বা কমিশনারের সাথে এখন পর্যন্ত মতবিনিময় করেনি; এবং অনুসন্ধান বা তদন্তনাধীন কোন ব্যক্তির বা সংগঠনের সাথে মতবিনিময় করেনি। এখানে আমরা দেখব প্রচলিত আইন ও বিধিমতে দুদকের কাজের মূল পয়েন্টগুলো কি? এইকাজগুলো করতে বাধা কি এবং বাধাগুলো উত্তরণের উপায় কি?

দুদকের প্রধান কাজঃ 

ক) দুর্নীতি সংক্রান্ত কিছু নির্দিষ্ট অপরাধ আমলে নেওয়া এবং এগুলোর অনুসন্ধান ও তদন্ত করা। 

খ) দুর্নীতি প্রতিরোধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া।

গ) দুর্নীতি প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা। 

ঘ) অনুসন্ধান ও তদন্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অভিযুক্তকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে শাস্তি নিশ্চিত করা। 

ঙ) নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা। 

চ) প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি দমন, ফাঁদ মামলা পরিচালনা, আর্থিক ও শিল্পখাতে দুর্নীতি দমন কার্যক্রম পরিচালনা করা।

ছ)  মানি লন্ডারিং বিষয়ে দুর্নীতি দমনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। 

দুদকের কাজ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাঃ 

দুদক আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। বাস্তবতা হল দুদক আইনে স্বাধীন; কিন্তু কার্যক্রমে নতজানু,মুখাপেখী। 

দুদকের কার্যক্রমে  সফলতা না আসার উল্লেখযোগ্য কারন হলঃ

ক) অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজে সম্পৃক্ত IO/EO দের জন্য উক্ত কাজে কোন বরাদ্দ থাকে না। মামলার অনুসন্ধান ও তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর নিজের টাকা দিয়ে PO visit, কাগজপত্র কেনা, বিভিন্ন দপ্তরে documents searching করা সহ এ সংক্রান্ত সকল কাজ করতে হয়। 

খ) দুর্নীতিবাজরা প্রভাবশালী হয়। দুর্নীতিবাজদের রোষানলে পড়ে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে হয়। 

গ) দুদকের অভ্যন্তরীণ পদস্থ কর্মকর্তাদের একাংশ কর্তৃক অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষেত্রে IO/EO কে অনৈতিকভাবে প্রভাবিত করা। 

ঘ) বিভিন্ন উৎস বিশেষকরে সাধারণ জনগণ হতে প্রাপ্ত অভিযোগ সমূহের অব্যবস্থাপনা ও আমলে না নেওয়া।

ঙ) ক্ষমতাধর মহলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারা।

চ) সরকার বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া। 

উত্তরণের উপায়ঃ 

ক) দুদকে মূল কাজ করে কমিশন, IO, EO।  কমিশনের সচিব থেকে এমএলএসএস পর্যন্ত সবাই ক্ল্যারিকাল কাজ করে; দুর্নীতি রোধ সংক্রান্ত কাজে এদের ভুমিকা রাখার সুযোগ নেই বললেই চলে। দক্ষ, সৎ, নিরপেক্ষ ও দৃড়চেতা মনোবল এর লোক দিয়ে কমিশন গঠন করতে হবে। 

খ) IO/EO গণ যাতে রাজনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান ও তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। 

গ) প্রত্যেকটি অনুসন্ধান ও তদন্তের দায়িত্ব দেওয়ার সময় IO, EO এবং তদারককারী কর্মকর্তার অনুকূলে পর্যাপ্ত থোক বরাদ্দ প্রদান করতে হবে।

ঘ) IO, EO এবং তদারককারী কর্মকর্তারদের পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে হবে। 

ঙ) মাসের নির্দিষ্ট দিনে বিগত মাসের মামলায় হারা বা জেতার কারন ডিজিটাল ফ্ল্যাটফর্মে পর্যালোচনা করে পুরস্কার ও তিরস্কার এর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 

চ) দুদকে বর্তমানে কর্মরত জনবলের তুলনায় ৪•৩৪% লোকবল এবং প্রেষণের জন্য মঞ্জুরকৃত পদের তুলনায় ৫•৩৪% লোকবল প্রেষণে কর্মরত আছে। কমিশনের কর্মকতা কর্তৃক হয়রানি ঠেকাতে , চেক ও ব্যালেন্স এর জন্য এবং এক্সপার্ট লোক বাড়াতে বিভিন্ন দপ্তর থেকে প্রেষণে নিয়োগের হার নির্দিষ্ট করা এবং তা কমপক্ষে ২০% করতে হবে। 

ছ) দুদকে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আলাদা উচ্চতর বেতন কাঠামো থাকতে হবে। এতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন-যাপন করতে পারবে এবং দুর্নীতিতে জড়ানোর হার কমবে।

জ)  দুদকে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নিজেরা তদন্ত করে বিধায় তা ধামা-চাপা পড়ে। দুদক কেবিনেট ডিভিশনের সাথে কাজ করে বিধায় এটির অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির তদন্ত ক্যবিনেট ডিভিশনের মাধ্যমে করাতে হবে। 

ঝ) যাবাক ( যাচাই বাচাই কমিটি ) কর্তৃক কোন আবেদন অনুসন্ধান বা তদন্তের জন্য যদি গ্রহণের সুপারিশ না করা হয় তাহলে তার ব্যাখ্যা থাকতে হবে। 

ঞ) যাবাক  কর্তৃক যে সকল  আবেদন অনুসন্ধান বা তদন্তের জন্য  গ্রহণের সুপারিশ করা হয় বা না হয় তার তালিকা ওয়েবসাইটে প্রতিমাসে প্রকাশ করতে হবে। 

ট) IO,EO এবং তদারককারী কর্মকর্তা কমিশনের লোকবল বিধায় যাবাকে সম্পুর্ণভাবে প্রেষণের লোকবল থেকে পদায়িত করতে হবে। 

ঠ)ক্ষমতাসীন দলের এমপি, সেনাবাহিনী, প্রশাসন ক্যাডার, বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে চলমান অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রমের আপডেট ওয়েব সাইটে প্রকাশ করতে হবে। 

ড) দুদকের মূল কাজ অনুসন্ধান, তদন্ত শেষে বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা। এই কাজ ডিএডি গণ করে ও তারা যথেষ্ট দক্ষ। তাই দুদকের অফিসার লেভেলে এন্ট্রি পদ ডিএডি এবং সর্বোচ্চ পদ ডাইরেক্টর করতে হবে। নীতি নির্ধারণী পদ্গুলো প্রেষণের মাধ্যমে নিয়োগ দিতে হবে। 

ঢ) উন্মুক্ত লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে আইনজীবী প্যানেল নিয়োগ করতে হবে এবং উচ্চতর মাসিক ভাতা প্রদান করতে হবে। 

ণ) দুদকের এডি/ডিডি গণ বিসিএস এ এডমিন, পুলিশ, পররাষ্ট্র ক্যাডার না পেলে যেতে চান না। এর মূল কারন হলো এখানে ক্ষমতা ও অবৈধ টাকা আয়ের সুযোগ আছে। বৈধভাবে বেশী বেতন- ভাতা দিয়ে অবৈধ টাকা আয় কে নিরুৎসাহ করতে হবে; এবং বেশী পরিমাণে প্রেষণে নিয়োগ দিয়ে ক্ষমতার চেক এন্ড ব্যালেন্স করতে হবে। 

মূলত দুদক আইন ও বিধিমালা দুর্নীতি প্রতিরোধ, দমনে যথেষ্ট। বিদ্যমান আইন ও কাঠামোর ব্যপক পরিবর্তন জগাখিচুড়ী অবস্থার সৃষ্টি করবে। বিদ্যমান আইন ও বিধিমালার প্রয়োজনীয় অংশ সংশোধন করে তা নির্ভয়ে ও পক্ষপাতহীনভাবে প্রয়োগ করার গ্যারান্টি প্রদানের ব্যবস্থা করতে পারলে দুদক সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম স্বার্থকতা পাবে।