চার বছর ধরে রংপুরের খাদ্য গুদাম গুলো ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছে না।কোন কোন মৌসুমে চাল সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রা পুরন হলেও ধান সংগ্রহে হোঁচট খাচ্ছে।রংপুর জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি ধান উৎপাদন হলেও নানান কারণে ধান সংগ্রহে বারবার ব্যর্থ রংপুরের সমস্ত খাদ্য গুদাম গুলো।এবার ধান সংগ্রহে ব্যর্থ হলেও,চালে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছে।
চলতি বছর রংপুর জেলায় আমন ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযান শেষ হয়েছে গত ৩১ আগস্ট।নির্ধারিত সময়ে চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলেও,ঘাটতি রয়ে গেছে ধানে। ৮ হাজার ৮৬২ টন ধান সংগ্রহ করার কথা থাকলেও গুদামজাত হয়েছে ৫ হাজার ৭৭৫ দশমিক ৫৬০ টন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেছেন, সংগ্রহের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত দামের তুলনায় বাজারে বেশি দরে ধান বিক্রি করছেন কৃষকেরা।তাই গুদামে ধান দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেনা কৃষক ও মিল মালিকেরা।অন্যান্য বছর ধান সংগ্রহের সময় বাড়ানো হলেও এবার তাও নেই।অন্যদিকে কৃষকেরা বলছেন,অফিসে ঘুষ,হয়রানি,পরিবহন ব্যয়সহ নানান কারণে তারা ধান দিতে আগ্রহ দেখান না।
রংপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৮৬২ টন।সংগ্রহ হয়েছে ৫ হাজার ৭৭৫ দশমিক ৫৬০ টন।চালের মূল লক্ষ্যমাত্রা ছিল,৩১ হাজার ২৯৮টন।এছাড়াও আরো অতিরিক্ত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮হাজার ১২৭ টন।সংগ্রহ হয়েছে ৩২ হাজার ১৮৭ দশমিক ২২০ টন।
রংপুরের আট উপজেলায় ধান চাল সংগ্রহের পরিসংখ্যান অনুযায়ী,সদর উপজেলায় ধান সংগ্রহ হয়েছে,৩৮৩ দশমিক ৪০ টন।চাল সংগ্রহ হয়েছে,৫ হাজার ২৮০ দশমিক ৩৬০ টন। বদরগঞ্জে ধান সংগ্রহ হয়েছে ১ হাজার ১৮৮ দশমিক ৪০০ টন। চাল সংগ্রহ হয়েছে,২ হাজার ৩৪ দশমিক ৯৬০ টন।মিঠাপুকুর উপজেলায় ধান সংগ্রহ হয়েছে,৭৯২টন।চাল সংগ্রহ হয়েছে, ৪ হাজার ৩২১ টন।পীরগঞ্জ উপজেলায় ধান সংগ্রহ হয়েছে ১ হাজার ১০১ টন ও চাল সংগ্রহ হয়েছে,৬ হাজার ৩২৪ দশমিক ৬৪০ টন।তারাগঞ্জে ধান সংগ্রহ হয়েছে, ১২৬ টন ও চাল সংগ্রহ হয়েছে,৮ হাজার ৮৬৯ দশমিক ৬৮০ টন।গংগাচড়া উপজেলায় ধান ও চাল সংগ্রহ হয়েছে যথাক্রমে, ৪৬১ দশমিক ১২০ টন ও ১ হাজার ৭৮৫ দশমিক ৭১০ টন।কাউনিয়া উপজেলায় ধান সংগ্রহ হয়েছে ৬১২ টন ও চাল সংগ্রহ হয়েছে ১ হাজার ৩৮৮ দশমিক ৩৪০ টন।পীরগাছা উপজেলায় ধান ও চাল সংগ্রহ হয়েছে যথাক্রমে ১ হাজার ১১২ টন ও ২ হাজার ১৮২ দশমিক ৮০ টন।
গত বছর নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ১১ হাজার ৬২ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে গুদামজাত হয়েছিল,১ হাজার ২৬২ দশমিক ৪৪০ টন।অন্যদিকে,৪০ হাজার ২০৮ টন চাল সংগ্রহের বিপরীতে,সংগ্রহ হয়েছিল,৩৮ হাজার ৫৯৮ টন।এবছর চালের দাম প্রতি কেজি ৩২ টাকা নির্ধারণ করায় গত বছরের চেয়ে চাল সংগ্রহ বেড়েছে। তবে,শেষের দিকে পূর্বা অঞ্চলে বন্যার কারণে ধানের দাম কিছুটা বেড়েছে। এ কারণে ধান সংগ্রহ অভিযানে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয় বলে, জানিয়েছেন মিল মালিকেরা।
কৃষকদের অভিযোগ, ১৪ শতাংশ আর্দ্রতা না থাকলে খাদ্য গুদাম ধান নিতে চায় না।অনেক সময় এ কারণে খাদ্য গুদামে ধান দিতে গিয়ে ফিরে আসতে হয়।এছাড়াও প্রতি টন ধানে কর্মকর্তাদের জন্য, পরিবহন ব্যয়,শ্রমিকদের চাঁদা বাবদ সব মিলিয়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা ব্যয় হয়। এ কারণেই, কৃষকেরা খাদ্য গুদামে ধান দিতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। এ কারণে খাদ্য গুদাম কয়েক বছর ধরে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধান সংগ্রহ করতে পারছে না।
কর্মকর্তাদের অভিযোগ সংগ্রহ প্রক্রিয়া জটিল হওয়ার কারণে কৃষকেরা ধান দিতে পারেন না। একই সঙ্গে দালাল ও ফড়িয়াদের দৌরাত্যে্ন সরকার নির্ধারিত দাম থেকে কৃষকেরা বঞ্চিত হন। এ কারণে কৃষকেরা অভিযানের শুরু থেকেই ধান সংগ্রহ প্রক্রিয়া সহজ করার দাবি জানিয়ে আসছেন। কৃষক রমেশ চন্দ্র এই প্রতিবেদককে বলেন,এক মন ধানের মূল্যের চেয়ে একজন দিনমজুরের মজুরি বেশি। এক মন ধান বিক্রি করে এক কেজি গরুর মাংস কিনতে পারিনা।
আরেক কৃষক সৈয়দ আবু তালেব বলেন,কৃষকের দুঃখ দেখার কেউ নেই। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে ফসল উৎপাদন করেও আমরা লাভের মুখ দেখিনা। খরচ যেভাবে বাড়ছে তাতে করে আবাদ করাই কষ্টকর হয়ে গেছে। সরকার তো উৎপাদনের সময় আমাদেরকে কৃষি পণ্যের উপর কোনরূপ ভুত্বকি দেন না। ধানের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত এবং সরকারি উদ্যোগে হাটে হাটে ক্রয় কেন্দ্র খুলে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের দাবি জানিয়েছেন কৃষক সংগ্রাম পরিষদের নেতারা। তারা বলেন, সরকার যে পরিমাণ ধান চাল সংগ্রহ করে তা উৎপাদনের তুলনায় একেবারেই কম।
প্রান্তিক কৃষকদের কথা বিবেষণায় রেখে ধান সংগ্রহের প্রক্রিয়া আরো সহজ করাসহ উপজেলা পর্যায়ে পেডি সাইলো নির্মাণ করা এখন সময়ের দাবি। তারা আরো বলেন, প্রতিবছর উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া কৃষকের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সার,ডিজেল, কীটনাশকসহ প্রতিটি কৃষি উপকরণের মূল্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষক আবাদ করতে গিয়ে ঋণের জালে জর্জরিত হচ্ছে। ধান বিক্রি করতে গিয়ে কৃষক তার উৎপাদিত ব্যয় হিসেবে ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। তাছাড়া সরকার যে প্রক্রিয়ায় ধান ক্রয় করে তাতে বড় ব্যবসায়ী,
মধ্যস্বত্ত্বভোগী,ফড়িয়া ও দালালেরা লাভবান হয়। এ অবস্থায় সরকারের উচিত উপযুক্ত মূল্য দিয়ে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করা। এ ব্যাপারে রংপুর মহানগর মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম বাবু বলেন, এবারে ধান চাল সংগ্রহের অভিযানে আমি ১ হাজার ৭০০টন চাল দিয়েছি।ধান দিতে পারিনি।কারন প্রথমের দিকে কিছুটা লাভ হলেও শেষের দিকে ধানের দাম বেড়ে যায়।বর্তমানে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ১হাজার ২৫০ টাকা।রংপুর কৃষক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, সরকারের হাতে ধান চাল না থাকলে,বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে মজুতদার এবং
চালকল মালিকদের হাতে।এলএসডি গোডাউনগুলো মধ্যসত্ত্বভোগীদের দখলে থাকার কারণে সাধারণ কৃষকেরা উপযুক্ত দাম পাননা।উন্নয়ন গবেষকদের মতে,ধান চাল সংগ্রহ অভিযান ব্যর্থ হলে বাজার চলে যাবে মজুতদারদের হাতে।যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে স্বল্প আয়ের বিশাল জনগোষ্ঠীর উপর। এ অবস্থায় বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রয়োজনে খাদ্য আমদানি করে মজুত নিশ্চিত করারও পরামর্শ দেন তারা। ২০২৩ সালে রংপুর জেলায় বোরো মৌসুমে ধানের আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে। জেলায় বোরো সংগ্রহ অভিযানে ৪৫৩ জন মিল মালিক চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন।
এর মধ্যে অটো রাইস মিল ২৪ টি ও হাসকিং মিল রয়েছে ৪২৯টি।এবছর (২০২৪) বোরো সংগ্রহ অভিযানে সরকারিভাবে প্রতি কেজি ধান ৩২ ও চালের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ টাকা।যা গত বছরের চেয়ে ১ টাকা বেশি।রংপুর সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নিখিল চন্দ্র বর্মন বলেন,জেলায় মূল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চাল সংগ্রহ হয়েছে।তবে অতিরিক্ত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হয়নি। মূলত শেষের দিকে ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় এমনটা হয়েছে।এছাড়াও কৃষক সময় মত ধান শুকাতে না পারায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।এবার ধান ও চাল সংগ্রহে বর্ধিত সময় পাচ্ছেন না কৃষক ও মিল মালিকেরা।