তুর্কিতে নেওয়া পৃথিবীর অন্যতম খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচারকারী সাধু বা প্রেরিত পৌলের একটি লাইন আসলেই সত্য "লোভ করাই হলো সকল অশুভ শক্তির শেঁকড়." এবং আমি নিজে একটি মতে বিশ্বাস করি সেটি হলো- "অলসতাই হলো ধবংসের একটি পথ" এই দুইটি লাইন চেরনোবিল এর ক্ষেত্রে হোক বা ভোপালের ক্ষেত্রেই হোক,দুটোতেই সমান কার্যকরী।অসাবধানতার মাশুল স্বরুপ চেরনোবিলের দুর্ঘটনার ওই প্রভাব আমাদের পৃথিবী বিশ হাজার বছর ধরে ভুগবে।কিন্তু ভোপালের এই দুর্ঘটনার প্রভাব এই পৃথিবী কত বছর ভুগবে তার কোনো ইয়াত্তা এখনো কেউ জানেনা।আর হ্যাঁ যারা কীনা শুধুমাত্র ১৯৮৬ সালের ইউক্রেনের "চেরনোবিলের বিপর্যয়" সম্পর্কে জানেন,কিন্তু এর ঠিক দুইবছর আগের এই ঘটনা যার সম্পর্কে অনেকেই অবগত নয়,ঘটনার প্রেক্ষাপট জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।ভারতের কেন্দ্র হলো মধ্যপ্রদেশ।নামটাই তার জানান দেয়। মধ্যপ্রদেশের রাজধানীর নাম হলো ভোপাল।ঘটনার ঠিক পনেরো বছর আগে ১৯৬৯ সালে এখানে "ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেড" নামের একটি কোম্পানি দ্বারা পেস্টাসাইড বা কীটনাশক এর কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়।আর এই কারখানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে ওখানকার সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফুটে উঠে।কারণ ওই সময় ভোপালের প্রায় প্রত্যেকটা নিম্ন আয়ের মানুষ চাকরি থেকে বঞ্চিত ছিল।মানুষ তখনো কেমিক্যালের ভয়াবহতা সম্পর্কে তেমন সচেতন ছিলনা।তারা খালি জানতো যে এই চাকরি মোটামোটি রিস্কি এবং তারা টাকা পাবে।এইজন্য মানুষ টাকার জন্য এই কোম্পানিতে চাকরির জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে।আর এই কোম্পানিতে লোভ আর অসাবধানতা দুটিই ছিল।এই কোম্পানি "M.I.C.- Methyl Isocyanate"(মিথাইল আইসোসায়ানেট) উৎপাদন করতো।কোম্পানি এই ক্যামিকেলটাই কীটনাশক বানাতে ব্যবহার করতো।আর M.I.C. মানুষের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষতিকর ক্যামিকেল।কিন্তু এই কোম্পানি ভোপাল শহরের মধ্যে ৪২ টনেরও বেশি এম আই সি কারখানায় মজুদ করে রাখতো।কোম্পানির মালিক জানতো যে শহরে এই ক্যামিকাল রাখা কতটা বিপদজনক হতে পারে,তবুও তারা তা মজুদ করে রাখতো।আর প্রোডাকশন যেনো দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে এজন্য কোম্পানি পুরো শ্রমিক ও শহরের সেফটি কে ইগ্নোর করেছিল।আর এই ক্যামিকেল জলীয় পদার্থের সংস্পর্শে অনেক বাজে ভাবে বিক্রিয়া করে।আর একদিন এই পাম্প ফেটে যায়। ১৯৮৪ সালের ০২ ডিসেম্বর আনুমানিক রাত ১২ টায় ভোপালের ঘরে ঘরে মানুষের অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাশি আর শ্বাস প্রশ্বাসের কষ্ট দেখা দেয়।মানুষের রক্ত বমি হওয়া শুরু হয়।মানুষ গুলো বুঝতে পারেনি যে এগুলো কেন হচ্ছে।পরে তারা তথ্য পায় তৎকালীন ভোপালের সবচেয়ে বড় কারখানার "M.I.C." লিক হয়ে গিয়েছে।মেন্টেইনেন্ট আর ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের অসাবধানতার কারণে হঠাৎ "M.I.C." ভরা ট্যাংকি নং ৬১০ এ পানি যেতে থাকে।পানি তার নির্দিষ্ট জায়গা থেকে লিক হয়ে ওই ট্যাংকে যাওয়া শুরু করে।আর এই গ্যাস আর পানির মিশ্রণ থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই।পুরা ৪২ টন গ্যাসের ট্যাংকিতে পানি যাওয়া শুরু করে, আর এতে ট্যাংকিতে ভয়ানক চাপ তৈরি হয়।আর মিশ্রণের প্রভাবে বিক্রিয়া হয় আর সেই বিক্রিয়ার চাপ ট্যাংকি সহ্য করতে না পেরে সেটি বিস্ফোরণ হয়।আর ৪২ টন গ্যাস পরিবেশের বায়ুর সাথে মিশে যায়।আর এই গ্যাস শরীরের ভেতরের রক্তের সাথে মিশে, শ্বাসনালীর উপর অনেক চাপ সৃষ্টি করে যার জন্য শ্বাস নেওয়া অসম্ভব ছিল।এক ঘণ্টার মধ্যে ওই গ্যাস প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটার ব্যাপি ছড়িয়ে পড়ে।শ্বাস নেওয়া অসম্ভব ছিল।মানুষজন ঘর সম্পদ রেখে শ্বাস নেওয়ার জন্য অনেক দূরে যাওয়া শুরু করলো।শরীর থেকে চামড়া খসা শুরু করলো,এক সেকেন্ডে চোখের মণি গলে গিয়ে সাদা হয়ে গেল।কী ভয়াবহ!!ভোরের দিকে মানুষজন পুকুরে নদীতে ডুব দেওয়া শুরু করলো,(এই ভেবে যে তাদের শরীরের গ্যাস পানিতে ধুয়ে মুক্ত হয়ে যাবে।)কিন্তু তারা জানতোনা ওই গ্যাস সমস্ত পানিকে তেজস্ক্রিয় বানিয়ে ফেলেছিল।কিছুক্ষণের মধ্যে পুকুরে অসংখ্য লাশ ভেসে উঠলো!ভোর ৫টার পর পুরো ভোপাল জুড়ে লাশের স্তুপ লেগে যায়।একরাতের মধ্যে ওই শহরের মানুষ সব কিছু হাড়িয়ে ফেলে।রাস্তা,পুকুর,স্টেশন,বাসায় খালি পশু পাখি আর মানুষের লাশ পড়ে ছিল।অসংখ্য পরিবার, বাচ্চা,বাসা,জমি সব একরাতে ধবংস হয়ে গিয়েছে।পুরো ভারত ওদিন কেপে উঠেছিল।অফিশিয়াল রিপোর্ট অনুযায়ী ৩,৭৮৭ জন মানুষের মৃত্যু একরাতে হয়েছিল।

আর লাখ লাখ মানুষের শরীরের ওই গ্যাস প্রবেশ করে। তাদের ডিএনএ কে নষ্ট করে তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কে শারিরীক ও মানসিক ভাবে অক্ষম প্রজন্ম জন্ম দিতে চলেছিল।৫ লাখ মানুষ এই গ্যাসের সংস্পর্শে আসে।আর এই গ্যাস তাদের ও তাদের বাচ্চা এবং সেই বাচ্চার বাচ্চা এইভাবে একটির পর একটির প্রজন্মের মধ্যে এই অসুখের একটি ভয়ানক আশ্বাসবাণী দিয়ে গিয়েছিল।ওদিন তো তারা ভুগেছেই,কিন্তু ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য শারীরিক ও মানসিক ভাবে অক্ষমতার একটি চেইন ক্রিয়েট করে দিয়েছে।যারা কিনা ওই গ্যাসের সংস্পর্শে এসেছে তাদের সবারই নিউরোলজি জনিত সমস্যা, শারিরীক সমস্যা দেখা যায়।বাট এখনো ওখানকার মানুষ দাবি করে যে মৃত্যুর আসল সংখ্যাটা ষোলো হাজারেরও বেশি।আর প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায় যে প্রথম তিন দিনের মধ্যেই দশ হাজারের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। এরপর অনেকদিন কেটে গেল আর ওখানকার মানুষ উপলব্ধি করলো যে ওইরাতে যারা মারা গিয়েছে তারা অনেক সৌভাগ্যবান ছিল।আর ভাগ্য খারাপ তাদের যারা কিনা বেঁচে গিয়েছিল।ওই গ্যাসের প্রভাব এখনো আছে এবং সেটা আরও কতদিন থাকবে তার কোনো ইয়াত্তা নেই।ওই ঘটনার পরপরই ভোপালে ডিফিক্টিভ শিশুর জন্ম বহুগুণে বেড়ে গিয়েছিল।আর সেটা এখনো বৃদ্ধিশীল।জন্ম নেওয়ার প্রতি একশো শিশুর শতকরা পঁচিশজন প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্ম নেয়।কেউ বোবা হয়ে জন্ম নেয়,তো কেউ অন্ধ হয়ে।আবার কেউ মেরুদণ্ডহীন ছাড়া জন্ম হয় আবার কেউ ব্রেইন ও শ্বাসনালীর ক্যান্সার নিয়ে।এখনো অনেক মানুষ হাস্পাতালে রেগুলার চেকাপ করতে যায় ওই গ্যাসের কারণে তৈরি অসুখ নিয়ে বা ওটা সম্পর্কিত কোনো রোগ নিয়ে।এখনো সেই কারখানা ওরকম ভাবেই পড়ে আছে।আর সেই ক্যামিকেলের বর্জ্য ও কণা এখনো বিদ্যমান।এখনো ওই এলাকা থেকে অনেক দূর দূরান্ত পর্যন্ত মাটির নিচের পানি বিষাক্ত ক্যামিকেল দ্বারা দূষিত।যার কারণে এখনো মানুষ ওই পানি ব্যাবহার করছে যেখানে কীনা ওই গ্যাসের কিছু এলিমেন্ট আছে। আর ১৯৮৯ সালের ২৪ ই ফেব্রুয়ারী ওই উক্ত কোম্পানির চেয়ারম্যান ওয়ারেন এন্ডারসন ভারত সরকারকে ৪৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা বর্তমানে একচল্লিশ হাজার কোটি টাকার উপরে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয় তবে ওই সময় ডলারের মূল্য অনেক কম ছিল।কিন্তু এইটুকু কি যথেষ্ট?এই টাকার মূল্য কী প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জন্ম নেওয়া বিকল শিশুর জীবনের সমতুল্য? মানুষ কী তখনো সচেতন হয়েছিল?যদি হয়ে থাকে তাহলে ভোপালের ঘটনার দুই বছর না যেতেই চেরনোবিলের মাধ্যমে কীভাবে একই রকম ঘটনার পুনারাবৃত্তি ঘটলো?বাস্তবতা হলো মানুষ এখনো সচেতন না।প্রতিবারই মানুষ অর্থের লোভে কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ সেটা ভুলে যায়।জ্ঞান আর সচেতনতার অভাবে মানুষ অর্থকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়।আর মাঝের মধ্যে অসাবধানতার কারণে নিজের জীবন থেকেও বেশি গুরুত্ব দেয়।আর এখনো অনেক কারখানার মেশিনের মেইন্টেনেন্স হোক বা না হোক সেটা চলবে কিন্তু প্রডাকশন বিরতীহীন ভাবে চালু রাখা চাই!শ্রমিকের নিরাপত্তা হোক বা না হোক কিন্তু প্রোফিট প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি হওয়া চাই।অনেক কারখানাতে নিরাপত্তার জন্য দরকারি সরঞ্জাম কখনো রাখাই হয়না।"প্রফিট" মানুষ কে আসলেই অন্ধ করে দেয়।কোম্পানির মালিক কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ,কোনটা প্রয়োজনীয় তা সব জানা সত্ত্বেও শুধু অর্থের লোভে অন্ধ হয়ে যায়।