এসব পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞদের মধ্যকার আলাপ-
আলোচনার ভিত্তিতে বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করেন তাদের মতামতের ভিত্তিতে গৃহীত হয় না। অধিকাংশ সময় তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিজস্ব চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটাতে চেষ্টা করেন। তাই সমন্বয়হীন ভাবে গৃহীত পরিবর্তন অধিকাংশ সময় শিক্ষাবান্ধব হয় না। ফলশ্রুতিতে যা শিক্ষার গুণগতমান শিক্ষার্থীর বিকাশের পক্ষে সহায়ক হয় না। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য বিজ্ঞানমনস্ক ও বাস্তবসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে স্বাধীনতার পরপর বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই একটি "জাতীয় শিক্ষা কমিশন" গঠন করা হয় তবে এ কমিশন প্রণীত প্রস্তাবনা ও সুপারিশসমূহ ১৯৭৪ সালের মে মাসে প্রকাশিত হলেও বাস্তবে আলোর মুখ দেখেনি। ফলে আগেকার ধারায়ই শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত থাকে।
১৯৮৩ সালে সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ-এর সময়ে বাংলাদেশের শিক্ষা সংস্কারের উদ্দেশ্যে গঠিত একটি জাতীয় শিক্ষা কমিশন তৎকালীন শিক্ষা উপদেষ্টা ড. আবদুল মজিদ খান-এর নেতৃত্বে গঠিত হয়।এই কমিশন শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষার লক্ষ্য ও কাঠামো পুনর্গঠন এবং জাতীয় চাহিদার সাথে সংগতি রেখে আধুনিকীকরণে একাধিক প্রস্তাব ও সুপারিশ পেশ করে। কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৯৮৩ সালের "মজিদ খান শিক্ষানীতি" নামে একটি নতুন শিক্ষানীতি ঘোষণা করা হয়, যা পরে ব্যাপক বিতর্ক ও আন্দোলনের জন্ম দেয়।
১৯৮৭ সালে মফিজউদ্দীন আহমদ শিক্ষা কমিশন,১৯৯৭ সালের শামসুল হক শিক্ষা কমিশনকে পর্যালোচনা ও সংশোধনের মাধ্যমে ২০০২ সালে এই কমিটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উপরে নানা পরীক্ষা, পর্যালোচনা ও গবেষণা করে কিছু সংশোধনের সুপারিশ করে। তবে এই কমিশনের অনেক সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি, এইজন্য ২০০৩ সালে মনিরুজ্জামান মিয়া শিক্ষা কমিশন গঠনের প্রয়োজন পরে।
২০০৯ সালে তৎকালীন সরকার জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি ষোল সদস্য কমিটি গঠন করে। কমিটি ১৯৭৪ সালের কুদরত-ই-খুদা কমিশনের রিপোর্ট এবং ১৯৯৭ সালের শামসুল হক শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট অনুযায়ী জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ খসড়াটি আনুষ্ঠানিকভাবে ৭ই সেপ্টেম্বর ২০০৯-এ সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয় । যা পরবর্তীতে "জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০" নামে পরিচিত। সেখানে উচ্চ শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্বদানের উপযোগী বিজ্ঞানমনস্ক,অসাম্প্রদায়িক, উদারনৈতিক, মানবমুখি,প্রগতিশীল ও দূরদর্শী নাগরিক সৃষ্টি।
১৯৯১-এ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর থেকেই দেশে বেসরকারি, বাণিজ্যনির্ভর ও ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা সমধিক অগ্রাধিকার পায়। অদ্যাবধি যা অব্যাহত রয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে এ+, জিপিএ ফাইভ নামক ফলা ফলের প্রতিযোগিতা। আগে যেখানে ভালো শিক্ষার ওপর প্রাধান্য দেওয়া হতো, এখন তা অনেকাংশে ফলকেন্দ্রিক। ১৯৯১-এরপর পর থেকে মূলত: ভালো ফলাফলের প্রতিযোগিতা শুরু। ১৯৯২ সাল থেকে প্রথমবারের মতো এসএসসি পরীক্ষায় প্রতি বিষয়ের ১০০ মার্কের স্থলে ৫০ মার্কের জন্য নির্দিষ্ট প্রশ্নব্যাংক প্রচলন শুরু হয় যা বোদ্ধা মহলে সমালোচনামুখর ছিল। কারণ, এই প্রশ্নব্যাংক আদতে শিক্ষা বা জ্ঞানার্জন অপেক্ষা মুখস্থবিদ্যাকে উৎসাহিত করে। শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি নম্বর প্রদানের জন্য কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার কথাও জানা যায়, যা অতীতে কখনো ঘটেনি; অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের ভালো ফলের জন্য শিক্ষকদেরও বিশেষভাবে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে পাঠদানের মাধ্যমে নয়, নম্বর প্রদানের মাধ্যমে।
ফলে দেখাযায় যতজন পরীক্ষার্থী তার অর্ধেকের বেশি এ প্লাস বা জিপিএ ফাইভ পেয়ে থাকে। স্কুল অপেক্ষা মাদরাসা এবং গ্রাম অপেক্ষা শহরের দিকে ফলাফল ভালো করে ।
এর মধ্যে একটা অংশ এইচএসসি পাস করার পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হয়।অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় তাদের ফল খুবই হতাশাজনক। ভর্তি পরীক্ষায় ন্যুনতম নম্বর পর্যন্ত পায় না। যার ফলে দেখা যায় ভর্তি কোটা পুরন করতে সংকটে পারে বিশ্ববিদ্যালয় গুলো। এই যদি হয় শিক্ষার্থীদের অবস্থা তাহলে দূরদর্শী নাগরিক সৃষ্টিতে শিক্ষকদের ভূমিকা কতটুকু সহায়ক হতে পারে?
বর্তমানে মব সংস্কৃতির ফলে অনাকাংখিত ভাবে শিক্ষকদের কান ধরানো, পানিতে ডুবানো, লাঞ্ছনা করাসহ নানা ঘটনায় মিডিয়া সরগরম থাকে যা সত্যি লজ্জা এবং অপমানজনক । এই অপমানজনক অবস্থা থেকে শিক্ষকদের যেন মুক্তি নেই। অবশ্য শিক্ষকদের মাঝেও কিছুসংখ্যক রয়েছেন যারা অপরাজনীতিসহ নানা রকমের অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। তারাও শিক্ষার মান ও শিক্ষকদের সম্মান বিনষ্টের জন্য অনেকাংশে দায়ী। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষকের সংখ্যা ইত্যাদি রীতিমতো চরম বৈষম্যের রূপ ধারণ করেছে। দেখা যায় শিক্ষকগন মফস্বল শিক্ষকতা করলেও অবস্থান করেন শহরে। প্রাইভেট কোচিং বাণিজ্যের সাথে জরিত থাকেন। তাছাড়া বহুধাবিভক্ত জগাখিচুড়ি মার্কা শিক্ষার ধারায় এর থেকে বেশি কিছু আশা করাও কঠিন। শহর ও গ্রামের অব্যাহত বৈষম্যের কারণে দেখা যায় শহরের শিক্ষার্থীরা এসএসসি ও এইচএসসিতে তুলনামূলকভাবে ভালো ফল করে।
কিন্তু উচ্চশিক্ষার স্তরে এসে তারা সেই ধারা আর ধরে রাখতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বরং গ্রামের শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক ভাবে ভালো ফলাফল করে।
প্রশ্ন ফাঁস আরেকটি বড় ধরনের সমস্যা। প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিসিএস, মেডিকেলসহ প্রায় সকল সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়া এখন রীতিমতো স্বাভাবিক খবর। হাজার থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকায় প্রশ্ন বিক্রির কথা শোনা যায়, যা আদৌ কাম্য নয়। আগে কেবল চাকরির জন্য আর্থিক লেনদেনের কথা শোনা গেলেও এখন প্রশ্নপত্র, চাকরি, এবং বদলির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
নিত্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে শিক্ষা নিয়ে, পরিকল্পনার অভাব নেই, অথচ বাজেট কমেছে। গুরুত্ব হারাচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষা ব্যবস্থা ও অনুকূল-নিরাপদ ক্যাম্পাস। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক সংকটে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি যেখানে চরম আকার ধারণ করেছে সেখানে অপরিকল্পিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুরুত্ব হারাতে বসেছে। কারণ, যথোপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় উচ্চ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষার আরেকটি সংকট হলো শিক্ষাঙ্গনে নিরাপত্তা। ছাত্র রাজনীতি এবং যৌন সহিংসতা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে নিরাপদবোধ করা ঝুঁকিপূৃর্ণ ।শুধু তাই নয় সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের এক প্রার্থীকে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় আক্রমণ ও দলবেঁধে ধর্ষণের হুমকি দিয়েছেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থী সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আলী হুসেন। ইতোমধ্যে ছয় মাসের জন্য বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে আলী হুসেনের অভিযোগটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন বিষয়ক কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। কমিটির সুমতি হলে হয়তো দূর ভবিষ্যতে অভিযোগটি আলোর মূখ দেখতে পারে কিন্তু ইতোমধ্যে যদি আরো কোন দূর্ঘটনা ঘটে যায় সেক্ষেত্রে এ ঘটনা চাপা পড়ে যাবে।"বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতেই কাঁদবে"।
.বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারনে ক্যাম্পাসে এতো সংঘাত ও সহিংসতা। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাচ্ছন্দ্যের বদলে খুব অসহায়বোধ করে নিজেদেরকে। সেশন জট আজও যেন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। স্মরণ করিয়ে দেয় এরশাদ আমলের সেশনজটের কথা। যেটি দূর করার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করলেও শিক্ষকদের দায়বদ্ধতার জায়গাটা দুর্বল বিধায় সেশনজটমুক্ত ক্যাম্পাস গড়ে তোলা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ, কর্মসংস্থানের সুযোগ ইত্যাদি বিবেচনায় বর্তমানে অভিভাবকদের বিশেষ করে যাদের আর্থিক সঙ্গতি রয়েছে তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়মুখী প্রবণতাও লক্ষণীয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় পড়াশোনা শেষ করেই পাড়ি জমায় বিদেশে।
বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় গ্রাম-শহর, নারী-পুরুষ, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মূলধারা-মাদরাসা শিক্ষার মাঝে অব্যাহত ব্যবধান বা বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুযোগ গ্রহণ এবং এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এগিয়ে যেতে হলে এ সকল বিদ্যমান সংকটসমূহ নিরসনকল্পে নিত্য পরিবর্তনশীল শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করত বাস্তবসম্মত, বিজ্ঞানভিত্তিক ও একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন অপরিহার্য।
পাশাপাশি মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীকে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় যৌন সহিংসতার ভয়ের সংস্কৃতির মানসিকতা পরিহার করতে হবে।