টানা কয়েকদিনের অতিবৃষ্টি জনিত বন্যায় ভাসছে সাতক্ষীরায় সদর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন ও পৌরসভা আংশিক এলাকা।

টানা কয়েকদিনের অতিবৃষ্টি জনিত বন্যায় ভাসছে সাতক্ষীরায় সদর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন ও পৌরসভা আংশিক এলাকা। যত দিন যাচ্ছে ততই বন্যাদুর্গত এলাকায় মানুষ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে। বুধবার (১৬ অক্টোবর) সরেজমিনে দেখা যায় সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ধুলিহর ইউনিয়নের দামারপোতা, বড়দল, বাগডাঙ্গা, জিয়ালা, গোবিন্দপুর,নাথ পাড়া, তালতলা, কাজিরবাশা, বালুইগাছা, ধুলিহর সানাপাড়া সহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ প্রায় দুই মাস যাবৎ অতি বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতায় ভুগছে। সাতক্ষীরা সদরের ধুলিহর ইউনিয়নের ৪০ হাজার মানুষ বন্যার পানিতে প্লাবিত। ইতিমধ্যে অনেকেই ঘর বাড়ি ছেড়েছে। দীর্ঘ জলাবদ্ধতার কারণে পানি দূষিত হয়ে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে।  তাছাড়া প্লাবিত হওয়ায় হাঁস, মুরগি, ছাগল মরে দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকায়। এ সমস্ত এলাকায় স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় মল-মূত্র পানিতে ভেসে একাকার। ধুলিহর ইউনিয়নে বেতনা নদীর তীরে অবস্থিত এলাকায় গভীর নলকূপগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। খাবার পানির সংকটে ভুগছে এলাকাবাসি। গোবিন্দপুর গ্রামের জরিনা বেগম নামে ৬০ বছরের উর্দ্ধ বয়সী একজন মহিলা জানান, ১ দিন ভাত না খেয়ে বেঁচে থাকা যায় কিন্তু পানি না খেয়ে থাকা যায় না। আর সেই পানিটা যদি ময়লা দূষিত থাকে তাহলে কিভাবে আমরা বেঁচে থাকবো। খাওয়ার মত বিশুদ্ধ পানি এই এলাকায় নেই । ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার দূর থেকে পানি আনতে হয়। তবে সেই পানি আনতে লাগবে নৌকা বা ভেলা। আব্দুল মান্নান নামের এক ব্যাক্তি জানান, আমাদের এলাকায় খাবার পানির সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। সেই সাথে রান্না খাওয়ার জন্য কোন ভালো পানি আমাদের এলাকায় নেই। ইউনিয়নের বালুইগাছা গ্রামের বাসিন্দা সাংবাদিক সাহাদাত হোসেন বাবু বলেন, আমাদের এলাকার মানুষ বিগত ৫/৬ বছর ধরে জলাবদ্ধতায় ভুগছি তবে এবারের জলাবদ্ধতা ভয়াবহ বন্যায় আকার ধারণ করেছে। আমাদের এলাকা দীর্ঘদিন ধরে প্লাবিত হওয়ায় অনেক মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। সেই সাথে খাবার পানির সংকটে ভুগছে এলাকাবাসি। তবে জলবদ্ধ এলাকায় সরকারি এবং বেসরকারিভাবে তেমন সাহায্য সহযোগিতা কেউ পায়নি। এমনকি স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে কোন মেডিকেল ক্যাম্পেইনের ব্যবস্থা করা হয়নি। 

বড়দল গ্রামের ইউপি সদস্য এনামুল হক খোকন জানান, আমাদের এলাকায় কোন ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করলে তার দাফন করার মতো জায়গা নেই সব পানিতে প্লাবিত। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ধুলিহর ইউনিয়নে বিগত ৬-৭ বছর ধরে ভারী বর্ষণে প্রতিবছর ৬ মাস ধরে উপজেলার ধুলিহরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে স্থায়ীভাবে জলবদ্ধ থাকে। তবে এবারের অতি বৃষ্টির ফলে জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। খাল, বিল, রাস্তা ঘাট, পুকুর বাড়ি ঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মসজিদ মন্দির পানিতে প্লাবিত।তিনি আরো বলেন, ধুলিহর ইউনিয়নের দামারপোতা, বাগডাঙ্গা, বড়দল, জিয়ালা, গোবিন্দপুর, নাথপাড়া, তালতলা, বালুইগাছা, ধুলিহর সানা পাড়া, গ্রামের মানুষ পানিবন্দি। প্রতিটি গ্রামের ভিতরে রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে। যত দিন যাচ্ছে তত পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। দামারপোতা গ্রামের রবিউল ইসলাম জানান, আমার ঘরের ভিতরে পানি, রান্না ঘরে পানি পায়খানা ঘর পানিতে ভেসে গেছে। তবে জলবদ্ধতা নিরসনে বেতনা নদীর বিকল্প নেই। অপরিকল্পিত মাছের ঘের আর পাউবোর অপরিকল্পিত স্লুইস গেট সর্বনাশ ডেকে এনেছে। বেতনা নদী পূর্ণ খননের কাজ শুরু হলেও তিন বছর ধরে এখনো নদী খননের কাজ শেষ হয়নি। সে কারণে চলতি বছরেও বেতনা নদী দিয়ে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। বেতনা নদীর তীরবর্তী ২৫-৩০ গ্রামের ফসলি জমি, মৎস্য ঘের পুকুর পানিতে ডুবে গেছে। তাছাড়া, দেখা গেছে, জলাবদ্ধতায় নাকাল বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীর মধ্যবর্তী ৬ ইউনিয়নের মানুষ। ইউনিয়নগুলো হল বল্লী ঝাউডাঙ্গা, লাবসা, ব্রহ্মরাজপুর , ধুলিহর ও ফিংড়ী। এছাড়াও সাতক্ষীরা পৌরসভার পূর্বাংশের মানুষ জলাবদ্ধতায় নাকানি- চুবানি তো খাচ্ছেনই। জলবদ্ধতা এখন সাতক্ষীরা পৌরসভার মানুষের অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণমাধ্যমকর্মী জিএম আমিনুল হক বলেন, জলবদ্ধতা নিরসনে সরকার টাকা বরাদ্দ দেয়, সেই টাকা যায় পকেটে। কাজের কাজ কিছুই হয় না। বেতনা নদী খননের নামে যে খাল খনন করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সেই খালে পানি সরে না। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার জলবদ্ধতা কবলিত বিলগুলো হলো- বুড়ামারা, পালিচাঁদ, ঢেপুরবিল, চেলারবিল, হাতিশালার (হাচ্চালার) বিল, কচুয়ার বিল, হাজিখালি বিল, ডাইয়ের বিল, রামচন্দ্রপুরবিল ও ঘুড্ডিরবিল। এসব বিলে বছরের পর বছর পানি জমে সৃষ্টি হয় স্থায়ী জলাবদ্ধতা। 

অপরিকল্পিতভাবে বেড়িবাঁধ দিয়ে করা হয়েছে মাছের ঘের। স্থানীয়রা বলেন, প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও বৃষ্টি হলেই সাতক্ষীরা সদরের কয়েকটি ইউনিয়নের ২৫-৩০টি গ্রামে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।এছাড়াও সদরের ফয়জুল্যাপুর, বালিথা, শিমুলবাড়ীয়া, এল্লারচর, ফিংড়ী, গাভা, ব্যাংদহ, জোড়দিয়া, গোবরদাড়ী, সুলতানপুর, মজলিসপুর, হাবাসপুর ও কুলতিয়াসহ ব্রহ্মরাজপুর ইউনিয়নের মাছখোলা, নুনগোলা, রামচন্দ্রপুর, চেলারডাঙ্গা, বড়খামার, মেল্লেকপাড়া, উমরাপাড়া বাঁধনডাঙ্গাসহ সাতক্ষীরা পৌরসভার ৫টা গ্রাম স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার। গত কয়েক বছর যাবত বেতনা নদীর তীরে অবস্থিত এই এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ, গবাদিপশুসহ বিভিন্ন গৃহপালিত প্রাণী।প্রতি বছর জুলাই মাস আসতে না আসতেই সামান্য বৃষ্টি হলেই সাতক্ষীরার বেতনা পাড়ে অবস্থিত এসব গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যায়। এসব গ্রামের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। পানিবন্দি এসব মানুষের মধ্যে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত রোগ বালাই। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ডুবে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতি হলেও সেদিকে কারো নজর নেই।এছাড়া পর্যাপ্ত বৃষ্টিতে রাস্তা ঘাট পানিতে ডুবে যাওয়ায় এলাকায় জনজীবন আরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এলাকার বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।এদিকে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পেতে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে স্থানীয়রা হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন, সমাবেশ করলেও রাজনৈতিক ডামাডোলে সে সব আন্দোলন সংগ্রাম ভেস্তে গেছে। স্থানীয় প্রশাসন নেয়নি কোন পদক্ষেপ। এমনকি তৃণমূলের জনপ্রততিনিধিরাও রয়েছেন নির্বিকার।এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শোয়াইব আহমেদ বলেন, এলাকার টিউবওয়েল গুলো বৃষ্টির পানিতে ডুবে যাওয়ায় সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে সত্য। তবে আমরা বন্যার পানি সরানোর ব্যবস্থা করতে অনেক গুলো পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়েছে । কোথাও কোথাও রাস্তা কেটে দেয়া হয়েছে। প্রায় ২০ টি মোটর সেট করা হয়েছে। আশা করছি দ্রুতই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোস্তাক আহমেদ বলেন, সাতক্ষীরা পৌরসভা ও সদর উপজেলাকে জলাবদ্ধতা মুক্ত করতে আমরা সর্বোচ্চ সময় ব্যয় করছি। সদর উপজেলার সচেতন এলাকাবাসী এ স্থায়ী জলবদ্ধতা নিরসন ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।