বাংলাদেশ আজ এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের মুখোমুখি। একদিকে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রযাত্রা, কৃষিতে স্বনির্ভরতা যা উন্নয়নের প্রতীক। অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, বৈষম্য, অর্থনৈতিক অস্থিরতা আর আন্তর্জাতিক চাপ আমাদের সম্ভাবনাকে শ্বাসরোধ করছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও আমরা প্রশ্নে জর্জরিত এই দেশ কি সত্যিই আলোর পথে এগোচ্ছে, নাকি অন্ধকারের ঘূর্ণিতে আটকে যাচ্ছে?
কে.এম.মোজাপ্ফার হুসাইন
লেখক ও সমাজকর্মী
বাংলাদেশ আজ যেন এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের নাম। একদিকে পদ্মা সেতুর মতো অবকাঠামোগত বিস্ময়, তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব আর কৃষিক্ষেত্রে স্বনির্ভরতার গর্ব। অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, দুর্নীতি আর সামাজিক বৈষম্যের শ্বাসরোধী অন্ধকার। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর প্রশ্ন উঠছে আমরা কি সত্যিই মুক্ত হয়েছি, নাকি কেবলমাত্র শেকল বদল হয়েছে?
গণতন্ত্রের মূল প্রাণ হলো জনগণের অংশগ্রহণ। কিন্তু এখানে নির্বাচন মানেই ভয়, সংঘাত আর সন্দেহ। বিরোধী কণ্ঠকে দমন, প্রশাসনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানো আর গণমাধ্যমকে শেকলে বাঁধা এসবই সাধারণ মানুষকে আরও নিরাশ করছে। একটি রাষ্ট্র যদি জনগণের আস্থাই হারায়, তবে উন্নয়নের পরিসংখ্যান কেবল ফাঁপা বেলুনের মতো আকাশে ভেসে বেড়ায়।
অবস্থান স্পষ্ট বাংলাদেশের জন্য উত্তরণের একমাত্র রাস্তা হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক, সহনশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি। যেখানে সংলাপ থাকবে, আস্থা থাকবে, থাকবে জনগণের প্রকৃত ম্যান্ডেট।
বছরের পর বছর আমাদের অর্থনীতি গার্মেন্টস রপ্তানির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু রিজার্ভ কমে আসছে, ডলার সংকট বাড়ছে, মূল্যস্ফীতি মানুষের পকেট ফাঁকা করে দিচ্ছে। ব্যাংক খাত দুর্নীতি আর দায়মুক্তির রাজ্যে পরিণত হয়েছে। এই সংকট থেকে বের হতে হলে আমাদের সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে শুধু ঋণ নয়, বরং উৎপাদন খাতের বৈচিত্র্য নিশ্চিত করা জরুরি। তথ্যপ্রযুক্তি, ফার্মাসিউটিক্যালস, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, জাহাজশিল্প এসব ক্ষেত্রেই রয়েছে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ। কিন্তু এসব বাস্তবায়ন সম্ভব নয় যদি স্বচ্ছতা না আসে। ক্ষমতাশালী দুর্নীতিবাজদের আড়াল করলে কখনো টেকসই অর্থনীতি গড়া যাবে না।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি তার তরুণ প্রজন্ম। জনসংখ্যার এই সোনালি সুযোগকে বিশ্ব বলে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’। চীন এই শক্তি কাজে লাগিয়ে অর্থনীতিকে উড়ন্ত রকেটে পরিণত করেছে। অথচ আমরা এই শক্তিকে মাদক, বেকারত্ব আর বিদেশমুখী পাসপোর্টের লাইনে হারাচ্ছি।
যদি শিক্ষার মানোন্নয়ন না হয়, কারিগরি প্রশিক্ষণ না বাড়ে, আর স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য না হয়—তাহলে তরুণরা দেশ গড়ার বদলে দেশ ছাড়ার পথই বেছে নেবে। এখনই উদ্যোক্তা তৈরির উদ্যোগ, স্টার্টআপ ফান্ড, প্রযুক্তি সহায়তা আর সৃজনশীলতার অবাধ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তরুণদের হতাশা মানেই দেশের অন্ধকার।
বাংলাদেশে দুর্নীতি আর প্রশাসনিক দায়মুক্তি যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সরকারি প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয়, টেন্ডারবাজি, ঘুষ এসব সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকাকে লুটে নিচ্ছে। দুদককে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রেখে দুর্নীতি দমন সম্ভব নয়। প্রয়োজন স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, প্রয়োজন ই-গভর্নেন্স, প্রয়োজন কঠোর শাস্তি। একবার যদি সত্যিকার শাস্তির দৃষ্টান্ত তৈরি হয়, তাহলে সততা স্বপ্ন নয়, বাস্তব হতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের জন্য কেবল বৈজ্ঞানিক পরিসংখ্যান নয়, প্রতিদিনের বাস্তবতা। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন, লবণাক্ততা সবকিছুই আমাদের গ্রাম, শহর আর কৃষিকে ধ্বংস করছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ, উপকূলীয় সুরক্ষা আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্ষতিপূরণ আদায়ে কূটনীতি—এসব আমাদের টিকে থাকার লড়াই।
বাংলাদেশের অবস্থান কৌশলগতভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ যে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র সবার আগ্রহ এখানে। কিন্তু এই আগ্রহ কখনো আশীর্বাদ, কখনো অভিশাপ। তাই ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি ছাড়া আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। রোহিঙ্গা সংকট, প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকার, নতুন শ্রমবাজার এসব ক্ষেত্রেও দরকার কূটনৈতিক দৃঢ়তা।
এখন প্রশ্ন, এই অন্ধকার থেকে আলোয় যাওয়া সম্ভব কীভাবে? উত্তর একটাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এর সঙ্গে যোগ হতে হবে স্বচ্ছ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, সামাজিক সংস্কার, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ভারসাম্য।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আজকের সিদ্ধান্তের ওপর। আমরা কি সাহসী হবো? আমরা কি স্বচ্ছ হবো? আমরা কি জনগণের কাছে দায়বদ্ধ হবো? যদি উত্তর ‘হ্যাঁ’ হয়, তবে এই জাতি অন্ধকার ভেদ করে নতুন ভোর দেখতে পারবে।
সবচেয়ে বড় শক্তি হলো আমাদের মানুষ। গ্রামের কৃষক থেকে শুরু করে শহরের উদ্যোক্তা সবাই যদি বিশ্বাস করে যে এই দেশ তাদের, তবে বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য হবে। আর এখানেই আসল লড়াই আস্থা ফিরিয়ে আনা।
অতএব, সংকট যতই বড় হোক, এই জাতির ভেতরে সম্ভাবনার শক্তি আরও বড়। চ্যালেঞ্জকে ভয় না পেয়ে মোকাবেলা করতে পারলেই বাংলাদেশ তার স্বপ্নের ঠিকানায় পৌঁছাবে।