দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া। অস্থির অর্থনীতি। করোনা মহামারি আর যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক সংকট বাড়ছে হু হু করে। শ্রীলঙ্কা আর পাকিস্তান সংকট দক্ষিণ এশিয়ায় দিচ্ছে সতর্কবার্তা। ডলারের তুলনায় টাকার মানের পতন ঘটেছে রেকর্ড দরে। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। তেলের পর এরই মধ্যে আবার বাড়ছে বিদ্যুতের দাম।

মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতি, সংকট উত্তরণে করণীয়সহ বর্তমান প্রসঙ্গ নিয়ে জাগো নিউজের কথা হয় এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক, অর্থনীবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এবং অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে।

ড. দেবপ্রিয় তার মতামত জানিয়ে বলেন, ‘আমরা এক অস্বাভাবিক সময় পার করছি। এখানে তথ্যের ঘাটতি থাকলে সংকট মোকাবিলা করা যাবে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ে সরকারের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার বহু তফাৎ রয়েছে বলে মনে করি। বিবিএস ২০০৫-২০০৬ সালের ভোক্তাদের মাথায় রেখে মূল্যস্ফীতি ঠিক করে আসছে। ১৭ বছর পরেও সেই মানুষদের পরিবর্তনকে তারা ধরছে না। গ্রাম পর্যায়ে মূল্যস্ফীতির হার শহরের চেয়েও বেশি। এই চিত্র সঠিকভাবে তুলে এনে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

এই গবেষক পরিস্থিতি সামলে আনতে করণীয় হিসেবে উল্লেখ করেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন শুল্ক আরও বেশি পরিমাণে হ্রাস করা দরকার। কোন সেক্টরে শুল্ক কত বাড়ানো যায়, আর কোন কোন সেক্টরে শুল্ক আরও কত কমানো যায়, তার মধ্যে সমন্বয় জরুরি। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, সরকার যদি বড় আকারের ভর্তুকি দেওয়ার সক্ষমতা না রাখে সাধারণ মানুষ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভর্তুকি না বাড়ালে সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়বে।’

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সরকার বিদ্যুৎ বা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা অযৌক্তিক বলে মনে করি না। ভর্তুকি সমন্বয় করাই এখন সময়ের দাবি এবং এর জন্য আরও বেশি অর্থের সংস্থান করা দরকার। সাধারণ মানুষের হাতে ক্রয়ক্ষমতা থাকতে হবে। অপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি বন্ধ করতে হবে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন, বরাদ্দ বন্ধ করতে হবে। মানুষের বেঁচে থাকার ওপর জোর দেওয়াই এখন সময়ের দাবি।’

‘সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলছে। এটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কৃচ্ছ্রসাধন করে সামষ্টিক অর্থনীতিকে রক্ষা করা যায় না। এজন্য পূর্ণাঙ্গ নীতি প্রণয়নে বিবেচনা করা দরকার’-যোগ করেন ড. দেবপ্রিয়।ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বলেন, ‘চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আমদানি বেড়ে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাইরে অন্যান্য পণ্যের আমদানি বাতিল করতে হবে, যেগুলো পাইপলাইনে আছে এবং সেটা শিগগির করতে হবে। ভোজ্যপণ্য, মেশিনারিজ পণ্য যা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত সেসব পণ্য আমদানিতে জোর দিতে হবে। আর বিলম্ব করার সুযোগ আছে বলে মনে করি না।’

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বাজারে পণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, তা ছোট কোনো বিষয় নয়। এখানে বড় কোনো গোষ্ঠীর হাত রয়েছে। তারা পরিকল্পিতভাবে এটি করছে বলে মনে হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সুবিধায় কিনে তারা হয় মজুত করছেন না হয় অন্যত্র সরিয়ে রাখছেন। মনিটরিং বাড়ানো জরুরি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায় আছে এখানে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব। সরকার দোষ দিচ্ছে ব্যবসায়ীদের। ব্যবসায়ীরা দোষ দিচ্ছে বিশ্ব পরিস্থিতি বা সরকারের। এতে কোনো সমাধান আসবে না। সংকটকালে দোষারোপ করে সংকট আরও বাড়ানো হয়।’

‘এখনই মনিটরিং না বাড়াতে পারলে পরিস্থিতি ভালো যাবে না। চোখের সামনে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার ঘটনা দেখতে পাচ্ছি। ভারতের রুপির মানও পড়ে গেছে। এই পরিস্থিতি দ্রুত সামাল দিতে না পারলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে।’

‘সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা যথেষ্ট বলে মনে করি না। আরও পদক্ষেপ নিতে হবে। সাধারণ মানুষের কথা সবার আগে ভাবতে হবে। অবাঞ্ছিত ব্যয় রোধ করতে হবে। আজকের সংকটের জন্য প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণও দায়ী বলে মনে করি। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। লাখ লাখ কোটি টাকা বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে এটি হয়ে আসছে। ঠেকানো সম্ভব হয়নি। এর দায় কাউকে না কাউকে তো নিতে হবে’- যোগ করেন ড. সালেহউদ্দিন।