কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পের মুখ্য কেন্দ্রীয় চরিত্র ফটিকের কথা মনে আছে?

মামার বাড়িতে মামির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো ফটিকের জীবন। মামা বিশ্বম্ভরবাবু বলেছিলেন, স্কুলের ছুটি হলে ফটিককে নিয়ে দেশের বাড়ি যাবেন। কিন্তু চারপাশের পরিবেশ ক্রমশ বিরুদ্ধ হওয়ায় স্কুলের ছুটির অপেক্ষা না করে ফটিক একাই বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়ে পথে অসুস্থ হয়ে পড়ে। অসুস্থ ফটিককে পুলিশ বিশ্বম্ভরবাবুর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যায়। 

অসুস্থতার খবর পেয়ে গ্রাম থেকে ফটিকের মা ছুটে আসেন। বিশ্বম্ভরবাবু বহুকষ্টে তার বোনের শোকোচ্ছ্বাস নিবৃত্ত করেন। মা ফটিকের শয্যার ওপর আছাড় খেয়ে পড়ে উঁচুস্বরে ডাকলেন- “ফটিক! সোনা! মানিক আমার!” ফটিকের অতি সহজ উত্তর পেয়ে মা আবার ডাকলেন- “ওরে ফটিক, বাপধন রে!” ফটিক তখন আস্তে আস্তে পাশ ফিরে কাউকে লক্ষ না করে অতি মৃদুস্বরে বলল,-“মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।”

কবিগুরু ছুটি বলতে পৃথিবীর পাঠশালা থেকে ছুটি বা মুক্তিকে বুঝিয়ে ছিলেন। এই ছুটি ছিলো এ ঘর থেকে ও ঘরে যাওয়া, অর্থাৎ ইহলোক থেকে পরলোকে যাওয়া।

ঠিক জীবন-মৃত্যুর এমনই এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ছিলো রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় গুরুতর আহত সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম নাবিল রোহান। যে বিভীষিকা পেরিয়ে রোহান আজ বাড়ি ফিরলো, কবিগুরু বেঁচে থাকলেও হয়তো আবারও লিখতেন, ‘মা, আমার ছুটি হয়েছে, আমি এখন বাড়ি যাচ্ছি।’ তবে এই লাইনগুলো অবশ্যই হতো বাঁধভাঙা আনন্দ, উচ্ছ্বাসের।

রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় রোহানকে ছুটি দিয়েছে ঢাকার জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউট।

সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) ভয়াবহ এক স্মৃতিকে পেছনে ফেলে হাসপাতাল থেকে ১৪ বছরের কিশোর রোহান আজ বাড়ি ফিরেছে। বোন নূপুরে কণ্ঠে আজ খুশির সুর, কারণ ছোট ভাইকে সঙ্গে করে আজ বাড়ি ফিরছেন। উত্তরার ঘরটা আজ পরিপূর্ণ হবে অনেকদিন পর। শরীরের ৪০ ভাগ পুড়ে যাওয়া রোহান বলছে, ছুটি হয়েছে, বাড়ি ফিরে আবার ফুটবল খেলবো।

রোহান আর তার বোন নূপুর নানা গল্প করতে করতেই ফিরছিল প্রিয় বাড়ির উদ্দেশে। চোখে মুখে নতুন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে। দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে  তারা বলেন, সবাই প্রার্থনা করেছিলো মাইলস্টোনের আহতদের জন্য।

ছোট রোহানকে কোনো প্রশ্ন না করলেও বোনের পাশে বসে বললো- আজ ছুটি, তার দারুণ খুশির দিন। বন্ধুদের মনে পড়ছে। প্লে গ্রুপ থেকে এক সঙ্গে পড়া বন্ধু পাখি প্রেমী নাভিদ নাওয়াজ দীপ্তকে রেখে যাচ্ছে হাসপাতালে। সেও তাড়াতাড়ি স্কুলে ফিরবে এমনটাই চাওয়া তার। দৃঢ় মনোবলের রোহানের প্রত্যয় আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর। স্কুলে ফিরে সে শখের ফুটবল খেলতে শুরু করবে। 

জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় আজ দুপুরে রোহানকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। তার শরীরের ৪০ শতাংশ দগ্ধ ছিলো।

তিনি বলেন, মাইলস্টোন ট্রাজেডি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো। তার প্রতিষ্ঠানের পুরো টিম দিনরাত এক করে কাজ করেছে। ৪০ ভাগ পুড়ে যাওয়া রোহানকে সুস্থ করা এক অনন্য সফলতা। 

তিনি জানান, বাকি রোগীদের কাউকে বিদেশে নেওয়ার প্রয়োজন হবে না, তবে ব্যক্তিগতভাবে কেউ যেতে চাইলে যেতে পারে। ৪০ ভাগ পুড়ে যাওয়া রোহানকে সুস্থ করে ছুটি দেওয়া ছিলো কঠিন চ্যালেঞ্জ। বাকি ভর্তি ১০ জনকে যতো দ্রুত সম্ভব সুস্থ করে বাড়ি ফেরাতে চান।

ডা. নাসির উদ্দিন আরও বলেন, আমরা আশা করছি অন্য যারা এখানে ভর্তি আছেন তারাও শিগগির সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবেন। যাদের ছুটি দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে তারা পরবর্তী সময় জাতীয় বার্ন ইন্সটিটিউটে এসে চিকিৎসা নিতে পারবেন। প্রয়োজন হলে করাতে পারবেন অপারেশনও। 

মাইলস্টোন ট্রাজেডিতে পুড়ে যাওয়া সবার চিকিৎসা বিনামূল্যে করা হয়েছে এই ইন্সটিটিউটে। যাদের ছুটি দেওয়া হয়েছে তাদের পরবর্তী ফলোআপ এখানেই করা হবে। হাসপাতালের প্রতিনিধি সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে বলেও জানান পরিচালক।

এদিকে বার্ন ইন্সটিটিউটের বিভিন্ন কেবিনে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় আছে নাভিদসহ অন্যরা। তাদের বাবা মায়েরা সবার কাছে দোয়া চাইছে সন্তানের জন্য। একে একে সন্তানরা সুস্থ হয় ফিরছে তা তাদের আনন্দিত করছে। তারাও অপেক্ষায় বাড়ি ফেরার। 

নাভিদ নাওয়াজ দীপ্তর বাবা বিপ্লব জানান, লাইফ সাপোর্ট থেকে ফিরে ছেলে এখন কেবিনে চিকিৎসারত। পরিচালকসহ পুরো হাসপাতালের সবার কাছে কৃতজ্ঞতা জানান বাবা বিপ্লব। দিনরাত সবার অক্লান্ত চেষ্টায় ৫২ ভাগ দগ্ধ ছেলে দীপ্তও  ফিরে এসেছে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে।

গত ২১ জুলাই উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় শতাধিক।

এ নিয়ে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউট থেকে ২৬ জনকে ছাড়পত্র দেওয়া হলো। এই হাসপাতালে এখনও ১০ জন ভর্তি রয়েছেন। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এ হাসপাতালে ২০ জন মারা গেছেন।