স্বৈরাচারী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ হলেও পদত্যাগ করেননি আওয়ামী লীগের অনেক দোসররা। পর্দার আড়ালে থেকেও গেল সরকারের আমলের অনেক দুর্নীতি পরায়ণ - পদধারী কর্মকর্তারা এখনও বহাল তবিয়তে পূর্বের ন্যায় অন্যায়মূলক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এ যেন মরু-ঝড়ে বালুর ভেতর মাথা গুঁজে থাকা উটের মতোই অবস্থা। এমন একটি ঘটনার প্রমাণ মিলে নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার মহিলা ডিগ্রি কলেজে যে কলেজের অধ্যক্ষ দুর্নীতির গডফাদার ও দুর্গাপুরের আলোর বার্তা বাহক হিসেবে পরিচিত। তিনি দুর্গাপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ফারুক আহমেদ তালুকদার। জুলাই বিপ্লবের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দাবি ছিলো দুর্নীতি মুক্ত দেশ গড়া। দেশজুড়ে যখন দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসনের দাবি জোরদার হচ্ছে, তখন নেত্রকোনার দুর্গাপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ফারুক আহম্মদ তালুকদারের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এসেছে। দুর্গাপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যক্ষ ফারুক একই সঙ্গে নিজের প্রতিষ্ঠিত আলহাজ্ব মফিজ উদ্দিন তালুকদার কলেজের গভর্ণিং বডির সভাপতিও। এই দুই প্রতিষ্ঠান ছাড়াও দুর্গাপুরে বেশকয়েকটি স্কুল, মাদরাসা ও কোচিং সেন্টার খুলে শিক্ষাকে ব্যবসা বানিয়ে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দুর্গাপুর উপজেলা শাখার বর্তমান উপদেষ্টা অধ্যক্ষ ফারুক একইসঙ্গে দুদকের দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতিও। আওয়ামীলীগের কয়েকটি কমিটির এই নেতা ২০১৮ ও ২০২৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীতার জন্য দলীয় মনোনয়ন আবেদনও করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর পক্ষে গত ২৪ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করা হলেও প্রায় দুই মাসেও এর সুরাহা হয় নি। এমনকি প্রমাণসহ অভিযোগের কপি বিভিন্ন গণমাধ্যমে দিলেও, তা প্রকাশ করার প্রয়োজন বোধ করেন নি অনেক গণমাধ্যমকর্মীও। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রশাসনের অবহেলা, বিচারহীনতার পরিবেশ ও দুর্নীতির বিস্তার নিয়ে সমাজের নানা মহল থেকে তীব্র ক্ষোভ ও বিচারের দাবি উত্থাপিত হয়েছে। আমাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই অধ্যক্ষের নানা অপকর্ম ও দুর্নীতির বৃত্তান্ত। নিয়োগকালে ছিলো না কাম্য শিক্ষাগত যোগ্যতা, অবৈধ উপায়ে প্রভাষক পদে যোগদান: ছয় মাসের কম্পিউটার কোর্স করে বিতর্কিত উপায়ে সুসং মহাবিদ্যালয়ের ‘কম্পিউটার শিক্ষা’ বিষয়ে প্রভাষক পদে যোগদান করেন ফারুক আহম্মদ তালুকদার। নিয়োগকালীন সময়ে তার কাম্য শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিলো না বিধায় তাকে জাতীয়করণ প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেয়া হয়। যার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় কলেজটি জাতীয়করণ করার প্রাক্কালে ২০১৬ সালে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের অডিট রিপোর্টে। তাছাড়া তার নিয়োগ কালীন সময়ে বেসরকারি কলেজে কম্পিউটার শিক্ষক পদে নিয়োগের নীতিমালা অনুযায়ীও তিনি অযোগ্য। এই বিষয়ে জানতে চাইলে সুসং সরকারি মহাবিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, “ফারুক আহম্মদ তালুকদার রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশোনা করে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের কম্পিউটার শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক বনে যান। ওনি যে অবৈধ প্রক্রিয়ায় শিক্ষক হয়েছেন তার জন্য একটা প্রমাণই যথেষ্ট। ২০১৬ সালের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের করা অডিট রিপোর্টে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে তার নিয়োগকালীন সময়ে কাম্য শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিলো না।” অবৈধ পন্থায় ভাগিয়ে নিয়েছেন দুর্গাপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষের পদও ২০১৬ সালে সুসং মহাবিদ্যালয়ের জাতীয়করণের প্রাক্কালে কাম্য শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় জাতীয়করণ থেকে ছিটকে পড়েন অধ্যক্ষ ফারুক আহমেদ তালুকদার। এমতাবস্থায় তড়িঘড়ি করে পার্শ্ববর্তী দুর্গাপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের ‘অধ্যক্ষ’ পদ ভাগিয়ে নিতে অনৈতিক তদবির শুরু করেন। ২০১৭ সালে তৎকালীন স্থানীয় সাংসদ ও দুর্গাপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের গভর্ণিং বডির সভাপতি ছবি বিশ্বাস, গভর্ণিং বডির সদস্য আব্দুল্লাহ হক এবং তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আঃ আজিজের যোগসাজশে স্বজনপ্রীতি ও ২৬ লক্ষ টাকার অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে ফারুক আহম্মদ তালুকদার দুর্গাপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের ‘অধ্যক্ষ’ পদে যোগদান করেন এবং অদ্যাবধি তিনি স্ব-পদে কর্মরত আছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা মোতাবেক ডিগ্রি কলেজের ‘অধ্যক্ষ’ নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রভাষক বা সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন হয়। দুর্গাপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজ ২০০৫ সন থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিধায় অধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রে এ বিধিটি কার্যকর হবে। কিন্ত এ বিধিটি উপেক্ষা করে ১৫ বছরের কম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ফারুক আহম্মদ তালুকদারকে নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের চাকরি শর্তাবলি অনুযায়ী একজন অধ্যক্ষের ডিগ্রিস্তরে কমপক্ষে ১২ বছরের অভিজ্ঞতার বাধ্যবাধকতা থাকলেও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের কম্পিউটারের প্রভাষক ফারুক আহমেদ তালুকদারের তা ছিলো না। অতএব, অধ্যক্ষ পদেও তার নিয়োগ সম্পূর্ণ অবৈধ বলে প্রমাণিত। কাম্য শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একাধিক প্রার্থী থাকার পরও সকল নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ফারুক আহম্মদ তালুকদারকে নিয়োগ শুধু ‘অধ্যক্ষ’ পদটিকে কলংকিত করেনি, বরং কলেজ গভর্ণিং বডিকেও বিচারের মুখোমুখি করার দাবি অনিবার্য করে তুলেছে। অভিযোগগুলোর সত্যতা স্বীকার করে দুর্গাপুরের ডজনখানেক কলেজ শিক্ষক আমাদের সাথে কথা বলেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, “যেখানে মানবিক বিভাগ থেকে পড়াশোনা করে কম্পিউটার শিক্ষক হওয়া প্রকারান্তরে হারাম বলা চলে, আর তিনি ক্ষমতার জোরে তা করিয়ে দেখিয়েছেন। আর এইচএসসি পর্যায়ের সাবজেক্ট শিক্ষক কখনো ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ হতে পারে না। ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষক না হয়েও তিনি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ, যা কখনো সম্ভব না। অর্থ আর ক্ষমতার জুড়ে তিনি তাও করিয়ে দেখিয়েছেন।” এইপর্যন্ত এই দুর্নীতিবাজকে বিচারের মুখোমুখি করতে না পারার ব্যর্থতার জন্য প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভ জানিয়ে একজন শিক্ষক বলেন, “এর আগে যে বা যারা অধ্যক্ষ ফারুকের অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চেয়েছে তিনি প্রত্যেককে অনৈতিক সুবিধা অথবা বলপ্রয়োগ মাধ্যমে মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন।” স্থানীয় শিক্ষক সমাজের পক্ষ থেকে আরও অভিযোগ এসেছে, “অধ্যক্ষ ফারুক অবৈধ অর্থ কামিয়ে RAV4 জিপ গাড়ি কিনে ময়মনসিংহ বোর্ডের চেয়ারম্যানকে ব্যবহারের জন্য উপহার দিয়ে অবৈধ সুবিধা গ্রহণ করেছেন। ”আদালত অবমাননা ও তার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আইনি জটিলতা: - ২০ জুলাই ২০১৭ তারিখে এই দুর্গাপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের ‘অধ্যক্ষ’ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আদালত কর্তৃক সাতদিনের শোকজ জারির হওয়ার পরও আদালতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ২২ জুলাই ২০১৭ কলেজের তৎকালীন গভর্ণিং বডি কর্তৃক নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়। যা একইসঙ্গে আদালত অবমাননারও শামিল। এই ঘটনা আরও একটি প্রমাণ যে, অধ্যক্ষ ফারুক আহমেদ তালুকদার গং শুধু ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি, বরং আইনের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছেন। এই বিষয়ে আরও জানতে দুর্গাপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের অর্থনীতি বিষয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ শিক্ষক অধ্যাপক গৌতম কুমার মল্লিকের সাথে যোগাযোগ করা হলে অভিযোগগুলোর সত্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন, “অধ্যক্ষ পদে ফারুক আহম্মদ তালুকদারের নিয়োগ সম্পূর্ণ অবৈধ। আপনি চাইলে আমি এখনই তিনটি পয়েন্ট বলতে পারি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নীতিমালা অনুযায়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ হতে পনের বছরের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন তার সে অভিজ্ঞতা ছিলোটা এটা একটা কারণ। আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় একটা সার্কুলার অনুযায়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ হতে হলে ডিগ্রি স্তরে কমপক্ষে ১২ বছরের অভিজ্ঞতা লাগে, সে ছিলো উচ্চমাধ্যমিক স্তরের কম্পিউটার শিক্ষক তার অযোগ্যতার এটাও একটা কারণ। আর তার নিয়োগকালে এই নিয়োগের বিরুদ্ধে নেত্রকোনা জেলা জজ কর্তৃক সাতদিনের শোকজ নোটিশ জারির পরেও তা অমান্য করে সে নিয়োগ পায়- এটাও আরেকটা কারণ। এমন আরও অসংখ্য কারণ রয়েছে। তিনি সকল নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অবৈধভাবে অধ্যক্ষ হয়েছেন” এমনকি এই অবৈধ নিয়োগের বিরুদ্ধে মামলা করার কারণে অনেক হয়রানিরও শিকার হতে হয়েছে অধ্যাপক গৌতম কুমার মল্লিককে। কলেজটির তৎকালীন গভর্ণিং বডির সভাপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য ছবি বিশ্বাস সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছিলেন তাকে। তিনি বলেন, “হ্যাঁ, আমি এই অবৈধ নিয়োগের বিরুদ্ধে মামলা করার কারণে আমাকে তারা সাসপেনশন করে দেয়”। অবৈধ পন্থায় তার স্ত্রীকে বানিয়েছেন অন্য কলেজের অধ্যক্ষ ফারুক আহম্মদ তালুকদার অবৈধ অর্থ ও ক্ষমতার জোরে তার বাবার নামে দুর্গাপুরে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আলহাজ্ব মফিজ উদ্দিন তালুকদার কলেজ। ওই কলেজের গভর্ণিং বডির সভাপতিও তিনি। ওই কলেজের নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার স্ত্রী কামরুন্নাহার ২০১৫ সনে কোনো নিবন্ধন সনদ ও কলেজ/মাদ্রাসার প্রভাষক হিসেবে অভিজ্ঞতা ছাড়াই নিয়োগ লাভ করেন। এবং প্রথমেই ০৬ নং বেতন কোডে এমপিও ভূক্ত হন। কলেজে তার স্ত্রীর চেয়ে অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী থাকা স্বত্ত্বেও কোনো নিয়ম-নীতিমালার তোয়াক্কা না করেই অবৈধভাবে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেন তার স্ত্রী কামরুন্নাহারকে। শিক্ষার ফেরিওয়ালা সেজে গড়েছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়:- অনিয়ম, দুর্নীতি, আওয়ামী রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি গড়ে তুলেছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ দুর্গাপুর সহ-সভাপতি হিসেবে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে ২০১৮ ও ২০২৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীতার জন্য দলীয় মনোনয়ন আবেদন করেন। তিনি আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি হিসেবে প্রভাব খাটিয়ে নিজের বড় ভাই আওয়ামী লীগের দুর্গাপুর উপজেলা সভাপতি উসমান গণি তালুকদারকে কলেজ গভর্ণিং বডির সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করেন এবং ২০২৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে চারজন ল্যাব এসিস্ট্যান্ট নিয়োগ দেন। এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে শিক্ষক-কর্মচারী কেউই অবগত নন, যা ডার্ক নিয়োগ হিসেবে পরিচিত। এ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রায় অর্ধ কোটি অর্থের অবৈধ লেনদেন হয়। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে পুজি করে দুর্নীতির এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে তার বিচরণ ছিলো না। নামে-বেনামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখে সেগুলোতে নিয়োগ বাণিজ্য, নকল-জালিয়াতির মাধ্যমে মানহীন শিক্ষা, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে দুর্গাপুরবাসীর সার্বিক অগ্রগতির পথে নীরব ঘাতক হিসেবে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন। আমাদের অনুসন্ধানী টিম তাদের বিরুদ্ধে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের অডিট রিপোর্টে আর্থিক কেলেংকারীরও প্রমাণ পেয়েছে। দুর্গাপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের হিসাববিজ্ঞানের শিক্ষক আসাদুজ্জামান বলেন, “আমিও নিশ্চিত তার নিয়োগটা বৈধ না। টাকা-পয়সা দিয়ে সে অবৈধভাবে নিয়োগ নিয়েছে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে সে ১ লাখেরও অধিক টাকা মেরে দিয়েছে। আমি নিজেই একজন অডিট কর্মকর্তা। কলেজের অভ্যন্তরীণ অডিট কমিটির আমি নির্বাহী প্রধান। সে যে আর্থিক কেলেংকারী করেছে এই বিষয়ে প্রমাণসহ যে কারো সাথে কথা বলে রাজি।” এতো বড় দুর্নীতিবাজ কি করে দুদকের দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটিতে ঠাঁই পায় এই বিষয়ে উষ্মা প্রকাশ করে এই শিক্ষক বলেন, “এটা পৃথিবীর দশম আশ্চর্যের অন্তর্ভুক্ত করলে অবাক হবো না। আওয়ামীসন্ত্রাসীরা এভাবেই দুর্নীতি দমন কমিশন দুদককে ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছে।” অবৈধ পথে টাকা ঢেলে বিভিন্ন পদক ও সম্মাননা কুড়ানোরও অভিযোগ রয়েছে অধ্যক্ষ ফারুক ও তার স্ত্রী কামরুন্নাহারের বিরুদ্ধে। জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ২০২২ এ অধ্যক্ষ ফারুক এবং ২০২৩ এ তার স্ত্রী কামরুন্নাহার নেত্রকোনা জেলার শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ হিসেবে সম্মাননা ও পদকগ্রহণ সম্পর্কে মুখ একাধিক শিক্ষক। তারা বলেন, “অবৈধ পথে অর্থ ঢেলে তাদের এসব পদক অর্জন মূলত তাদের দুর্বলতা ঢাকার প্রচেষ্টা মাত্র। স্বচ্ছতার সাথে তদন্ত করলে সকল গোমর ফাঁস হয়ে যাবে।” নকলের মাধ্যমে শিক্ষার মানহানি: আলহাজ্ব মফিজ উদ্দিন তালুকদার কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্র তিনি যেই কলেজের অধ্যক্ষ সেই দুর্গাপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে তার ইচ্ছেমতোভাবে আসন বিন্যাস করে নকল/ অনৈতিক সুবিধা দিয়ে আসছেন। তার প্রতিষ্ঠিত আলহাজ্ব মফিজ উদ্দিন তালুকদার কলেজকে অসাধু উপায় অবলম্বন করে নাম-ডাক বৃদ্ধি করে শিক্ষা-বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ায় তার প্রধান লক্ষ্য। তার ব্যবসায়িক স্বার্থে আঘাত লাগলে স্থানীয় বিপথগামী শিক্ষার্থী, ছাত্রলীগ, নবীনলীগ, যুবলীগের সন্ত্রাসীদের দিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্ররোচিত করে মানববন্ধনেরও অভিযোগ রয়েছে উপজেলা আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা অধ্যক্ষ ফারুক আহম্মদ তালুকদারের বিরুদ্ধে। এই বিষয়ে জানতে দুর্গাপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বজলুর রহমান আনসারীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমি এই এলাকায় এসেছি খুব বেশি দিন হয় নি। তবে ২০২৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষার অনিয়মের বিষয়টা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। ওই কেন্দ্রে মফিজ উদ্দিন তালুকদার কলেজের শিক্ষার্থীদের নকল ও অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছিলো আমি তৎক্ষণাৎ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ওই কেন্দ্রে এক্সপেল করি। আমি শুধু চেয়েছিলাম সুষ্ঠু ও সততার সাথে যাতে পরীক্ষাগুলো সম্পন্ন হয়। অথচ অধ্যক্ষ ফারুক আহম্মদ তালুকদার কিছু শিক্ষার্থীকে লেলিয়ে দিয়ে আমার অপসারণের দাবিতে মানববন্ধনে দাঁড় করিয়ে দেয়। ”সুসং মহাবিদ্যালয়ের জাতীয়করণের পূর্বপর্যন্ত বেশ কয়েকটি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ‘কম্পিউটার শিক্ষা’ বিষয়টি পড়িয়েছেন ফারুক আহম্মদ তালুকদার। জালিয়াতির মাধ্যমে তার লেখা কম্পিউটার বইটি সুসং মহাবিদ্যালয়ের উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিটি ব্যাচের শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলকভাবে কিনতে হয়েছে। শুধু বই বিক্রি করে তিনি ১০-১২ বছরে আয় করেছেন ৫০-৬০ লাখেরও বেশি টাকা। তাছাড়া ওই কলেজের শিক্ষার্থীদের এইচএসসির কম্পিউটার বিষয়ে ব্যবহারিক খাতা বাবদ ৩০০-৫০০ টাকা বাধ্যতামূলক দেওয়া লাগতো। ব্যবহারিক খাতা তৈরি বা পরীক্ষা কোনোটারই ঝামেলা পোহাতে হবে না শিক্ষার্থীদের এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে কলেজটির ১০-১২ টি ব্যাচ থেকে কমপক্ষে অর্ধকোটি টাকা কামাই করেছেন তিনি। ওইসময়কার অসংখ্য শিক্ষার্থীর সাথে যোগাযোগ হয়েছে আমাদের অনুসন্ধানী টিমের। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকে তার দুর্নীতি আর অযোগ্যতার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ভুক্তভোগী একাধিক প্রাক্তন শিক্ষার্থী বলেছেন, “ফারুক আহমেদ তালুকদার একজন পুরোদস্তুর দুর্নীতিবাজ লোক। আমাদের সময়ে ফারুক আহম্মেদ সবাইকে বলপ্রয়োগ করে জালিয়াতির মাধ্যমে তার লেখা কম্পিউটার বইটি শিক্ষার্থীদের ক্রয় করাতেন। শুধু তাই না, এইচএসসি পরীক্ষায় কম্পিউটার বিষয়ে প্রাকটিকাল খাতা বাবদ তাকে বাধ্যতামূলক ৩০০-৫০০ টাকা দেওয়া লাগতো। আমাদের প্রতিটি ব্যাচে হাজার খানেক কম্পিউটার বিষয়ের ছাত্রছাত্রী ছিলেন। এভাবে প্রতিবছর বড় একটা টাকার অংক তিনি অনৈতিক ভাবে আদায় করে নিতেন। এর মাধ্যমে তিনি আমাদেরকে শুধু ব্যবহারিক পরীক্ষার অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত করেন নি, বরং এটি একজন শিক্ষার্থীর জন্য জীবন বিধ্বংসী কাজ। আমরা তার বিচার চাই।”রক্ষক যখন ভক্ষক: দুর্নীতি দমন কমিশনের নীতিমালায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য তাদের কমিটির পদে থাকতে পারবেন না। তা সত্ত্বেও অধ্যক্ষ ফারুক আহম্মদ তালুকদার এখনও দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির উপজেলা সভাপতির পদে রয়েছেন। এ ধরনের পদে থাকাকালে তার রাজনৈতিক পদ-পদবীর অপব্যবহার দুর্নীতি দমন কমিশনের আদর্শ ও নীতির পরিপন্থী। অধ্যক্ষ ফারুক আহমেদ তালুকদার উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ স্থানীয় নেতা, যিনি পরপর দুই জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলীয়ভাবে মনোনয়নের জন্য আবেদন করেছিলেন। কলেজের ভাবমূর্তি ও শিক্ষার মানহানি: দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির এই অধ্যক্ষের কারণে দুর্গাপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং তাদের অভিভাবকেরাও এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। শিক্ষক ও কর্মচারীদের সঙ্গেও তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার ও বৈষম্যমূলক আচরণ করেন, যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে নষ্ট করেছে। বিচার দাবি:- ফারুক আহমেদ তালুকদারের অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ সত্ত্বেও তার অপসারণের দাবি দীর্ঘদিন যাবৎ উপেক্ষিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ন্যায়বিচার ও দুর্নীতি মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে তাকে দ্রুত বিচার ও অপসারণের আওতায় আনার জন্য জনমতের চাপ ক্রমেই বাড়ছে। এই অধ্যক্ষের দুর্নীতির কারণে শিক্ষার পবিত্র পরিবেশ প্রতিনিয়ত কলুষিত হচ্ছে, যা সমাজের জন্য এক উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তার বিচার দাবি করে জনমত গড়ে উঠেছে, যা একদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করবে, অন্যদিকে প্রশাসনের প্রতি জনসাধারণের আস্থাকে পুনরুদ্ধার করবে। সুসং দুর্গাপুর দুর্নীতি ও নিপীড়ন বিরোধী ভার্সিটিয়ান মঞ্চের একজন শিক্ষার্থী তৌসফিক রাফি বলেন, “দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে যেভাবে একজন অধ্যক্ষ শিক্ষার পরিবেশকে বিষিয়ে তুলছেন, তা শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। দুর্গাপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ পদে একজন সৎ ও নীতিবান ব্যক্তির থাকা প্রয়োজন, যারা শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে শিক্ষার পথনির্দেশনা দিতে সক্ষম। অধ্যক্ষ ফারুক আহম্মদ তালুকদারের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষার গুণগত মান চরম সংকটে পড়তে পারে। তার অপসারণ ও বিচার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই শিক্ষার পরিবেশ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। আমরা অবিলম্বে এই দুর্নীতিবাজ শিক্ষককে অপসারণ ও বিচারের দাবি জানাচ্ছি। অন্যথায় আমরা দেশব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলন গড়ে তুলবো।” এই গত সেপ্টেম্বর মাসে এলাকাবাসীর পক্ষে অভিযোগ দিলেও কেনো এখন পর্যন্তপদক্ষেপ নেওয়া হয় নি এই বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নাভিদ রেজওয়ানুল কবীর বলেন, “আমি এই উপজেলায় নতুন যোগ দিয়েছি। আমি আসার আগে যদি কোনো রিপোর্ট জমা হয়ে থাকে তবে সেগুলো খুজে বের করে দেখতে হবে।” এ বিষয়ে দুর্গাপুর মহিলা কলেজের গভর্ণিং বডির সভাপতি এম এ জিন্নাহর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “গর্ভণিং বডির দায়িত্বে আমি সম্পূর্ণ নতুন। অধ্যক্ষ ফারুকের বিষয়ে বাইরে থেকে অনেকগুলো অভিযোগ আমার কাছে এসেছে। খুব শ্রীঘ্রই আমি কলেজের শিক্ষকদেরকে নিয়ে একটি মিটিং করব। তার বিষয়ে সবার অপিনিয়ন শুনবো। আমি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করেছি। জাতিসংঘেও কাজ করেছি। আমি আমার জীবনেও কখনো দুর্নীতি করি এবং দুর্নীতিকে প্রশ্রয়ও দেয় নি। তদন্ত ও প্রমাণ সাপেক্ষে তার বিষয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।” নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর ক্যাম্পে দায়িত্বরত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা বলেন, “হ্যাঁ আমরা অভিযোগ পেয়েছি। ওনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ও প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। শিক্ষার সাথে জড়িত কর্তৃপক্ষকে আমরা এই বিষয়ে জানাবো।” এই বিষয়ে নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, “ওনার বিষয়ে অভিযোগটি আমরা তদন্তের জন্য দিয়েছি। তদন্ত রিপোর্ট আসুক। তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে আমরা ওনার বিষয়ে ব্যবস্থা নেবো। ” এই বিষয়ে দুর্গাপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ফারুক আহম্মদ তালুকদারের কাছে জানার চেষ্টা করা হলে তার মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।