কাঠের বাক্সের ওপর একটি কাপড় পাতা। এর ওপর কয়েকটি গোলাকার দরজার হাতল ও তালা রাখা। সঙ্গে কয়েক রকমের চাবি। ওই বাক্স সামনে নিয়ে আনমনা হয়ে বসে ছিলেন আহমদ আলী (৫০)। তিনি একজন তালা-চাবির মিস্ত্রি। অন্যের ঘরের হারিয়ে যাওয়া তালার চাবি বানান তিনি। আবার নষ্ট হয়ে যাওয়া তালা সারাই কিংবা আলমারির তালা খুলে দেন। এভাবে সিলেট বন্দরবাজার এলাকার নগর ভবনের ফটকের সামনে তাঁর কেটেছে ১৫টি বছর। আহমদ আলীর বাড়ি দক্ষিণ সুরমা উপজেলার মোল্লারগাঁও ইউনিয়নের আজরাই গ্রামে। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে তাঁর। বড় মেয়ের বয়স প্রায় ১৮ বছর। অন্যরা বয়সে ছোট। পরিবারের উপার্জন করেন তিনি একাই। আগে অন্য ব্যবসা করলেও এখন তাঁর একমাত্র পেশা তালা-চাবি সারাই। এর আয় দিয়েই চলে তাঁর সংসার।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে নগর ভবনের ফটকের সামনে কথা হয় আহমদ আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে বন্দরবাজার এলাকায় চশমা বিক্রি করতেন তিনি। তবে সেটির ক্রেতা তেমন পাওয়া যেত না। আবার টাকাপয়সা বিনিয়োগ করতে হতো ভালোই। এ জন্য সে ব্যবসা ছেড়েছেন প্রায় ১৫ বছর আগে। এরপর তিনি তালা খোলা এবং চাবি বানানো শিখে সেটিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তিনি বলেন, সকাল ১০টার দিকে তিনি নগর ভবনের ফটকের সামনে এসেছেন। সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছিল। কেউ তালা খুলতে কিংবা তাঁকে খুঁজতে আসেননি। তাই বেলা একটা পর্যন্ত কোনো আয় হয়নি। এ জন্য তাঁর মনটা বিষণ্ন। তাঁর আশা, কেউ না কেউ নিশ্চয়ই আসবেন।
আহমদ আলী বলেন, কোনো কোনো দিন কেউ আসে না। আবার কোনো কোনো দিন ভালোই আয় হয়। দিনে প্রায় হাজার টাকাও আয় করেছেন তিনি। কেউ বাড়িতে নিয়ে গেলে সব থেকে বেশি আয় করতে পারেন। কোনো সময় খুশি হয়ে কেউ ৫০০ টাকাও দিয়ে দেন। আবার ২৫০ থেকে ৩০০ টাকাও পান। চাবি বানালে তিনি ২৫ থেকে ২০০ টাকা নেন। চাবির ধরন, আকার ও ফরমাশ বুঝে মজুরি নেন। তাঁর দাবি, তিনি কারও কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা দাবি করেন না। সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিনই আহমদ আলী এক স্থানে বসেন। তাঁর আশপাশে আরও ১৫ জনের মতো একই পেশার লোকজন বসেন। শুক্রবার বেলা একটার দিকে আরও দুজন বসে ছিলেন তাঁর কিছুটা অদূরে।
তাঁদেরও একই অবস্থা। কোনো কোনো দিন খালি পকেটেই তাঁদের বাড়ি ফিরতে হয় বলে জানান আহমদ আলী। ঈদ কেমন কাটল জানতে চাইলে আহমদ আলী বলেন, ‘কষ্টে গেছে ভাই। যত ঈদ পার্বণ আসে, সবই কষ্টে যায়। সংসারের খরচের তাগিদে ঈদের পরদিন অনেকে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটালেও আমি আয়ের জন্য হাজির হয়েছি। মাঝেমধ্যে ভালো আয় হয়। তা–ও হাজারখানেক। সে আয়ে দুই দিন চলা কষ্ট। তবে সেটিও তিন মাস ছয় মাসে। প্রতিদিনই যায় কষ্টে। ঘরের লোকজন আমার পথ চেয়ে বসে থাকে। বাড়ি গেলে এই নেই, সেই নেই। এভাবেই চলছে জীবন। অন্যের তালা অনায়াসে খুলতে পারলেও নিজের উপার্জন পথ তালাবদ্ধ। সে তালার চাবি খুঁজি সব সময়।’