প্রকৃতির মাঝে, খাগড়াছড়ি মুলত বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী যেমন ত্রিপুরা, চাকমা, মারমা অধ্যুষিত তবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালিদেরও বসবাস রয়েছে । এই জেলায়, ঢাকা থেকে এই জেলার দুরত্ব প্রায় ২৭২ কিলোমিটার, খাগড়াছড়ি এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার আওতাধীন ছিলো, ১৯৮৩ সালে খাগড়াছড়ি নামে নতুন জেলার সৃষ্টি হয়। এই জেলার ৯ টি উপজেলা আছে প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা সৌন্দর্য রয়েছে, এসব সৌন্দর্যের নানান বৈচিত্র্য আপনার মনকে করবে সতেজ, খাগড়াছড়িতে যেতে হলে হাতে দুই থেকে তিনদিন সময় নিয়ে যাওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে খাগড়াছড়ি সম্পর্কে মোটামুটি ধারনা পাওয়া যায়,খাগড়াছড়িতে ঘোরার উপযুক্ত সময় - পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে সারা বছরই ঘোরাঘুরি করা যায়, তবে বর্ষা ও শীতের সময় এই এলাকা ঘুরতে ভালো লাগে, বর্ষার সময় খাগড়াছড়ি ফিরে পায় তার আসল সৌন্দর্য, এই সময় মুল শহরের পাশে অবস্থিত আলুটিলা পাহাড়ে অনেক গুলো ঝর্ণা দেখতে পাওয়া যায়, এছাড়া বর্ষায় উচু পাহাড়ের গায়ে মেঘ রোদের খেলা করে যা এক কথায় অসাধারণ।
এছাড়া বাংলা চৈত্র মাসের শেষ তিনদিন আগে পাহাড়ি সম্প্রদায়ের বর্ষবরনের উৎসব বৈসাবিতে খাগড়াছড়ি সেঝে উঠে বর্ণিল সাঝে যা আপনাকে বিমোহিত করবে। খাগড়াছড়িতে যা যা দেখার আছে- প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি খাগড়াছড়ির প্রতিটি পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য, খাগড়াছড়িতে যেতে হলে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের বারৈয়ারহাট থেকে খাগড়াছড়ি রোডের কয়েক কিলোমিটার পার হলেই মুলত পাহাড়ি এলাকা শুরু হয়, এই এলাকার পাহাড়ি রাস্ত ও রাস্তা দুইধারে সেগুন বাগান, বারার বাগান, পাহাড়, নদী দেখলে দুই চোখ জুড়িয়ে যায়, এছাড়া চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি থেকেও খাগড়াছড়িতে আসা যায় পাহাড়ি রাস্তা, ঝিরি, ঝর্ণা ও নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে, এরকম জনপ্রিয় কিছু পর্যটন কেন্দ্রের ধারন দেওয়া হলো রামগড় চা বাগান ও ভারতের ত্রিপুরা ও রামগড় ট্রানজিট সেতু - রামগড় উপজেলা যেহেতু খাগড়াছড়ি জেলার প্রবেশ পথ তাই এই পথে পড়বে রামগড় চা বাগান যার দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ কিলোমিটার, ছোট ছোট পাহাড়ি টিলায় অবারিত সবুজের হাতছানি ক্ষনিকের জন্য হলেও মনকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে দেয়, চা বাগান পেরিয়ে রাস্তার বাম পাশে দেখা মেলে ফেনী নদীর উপর নির্মিত ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের ট্রানজিট সেতু, যার স্থাপত্য শেলী অনন্য, রামগড় উপজেলা বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন উপজেলা।
যার অবস্থান ত্রিপুরা রাজ্যে সিমান্ত ঘেঁষে, ত্রিপুরা ও রামগড় উপজেলার মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে বহুল আলোচিত ফেনী নদী, এখানেই ১৭৯৫ সালে ৪৪৮ জন সৈন্য নিয়ে রামগড় লোকাল ব্যাটিলিয়ান নামে শুরু হয় বর্তমান বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবির কার্যক্রম, যে স্থানটির অবস্থান রামগড় উপজেলা পরিষদের ভিতরে, এছাড়াও এখানে অনেক দর্শনীয় স্থানের দেখা পাওয়া যায়গুইমারা উপজেলার জালিয়াপাড়া - মহালছড়ি সড়ক - বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কতৃক পাহাড় কেটে জালিয়াপাড়া থেকে মহালছড়ি উপজেলা পর্যন্ত অত্যান্ত সুন্দর ও আকর্ষনীয় ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই রাস্তাটি তৈরি করা হয়, রাস্তার দু'ধারের জনবসতি, পাহাড় ও ঘন জঙ্গল সত্যিই মনোমুগ্ধকর, এই রাস্তা শেষ প্রান্ত মহালছড়ির ২৪ মাইল এলাকায় অনেকগুল রেস্টুরেন্ট আছে যেখানে পাহাড়ি বিভিন্ন পদের দুপুরের খাবার সহ সতেজ খাবার পাওয়া যায়।দেবতা পুকুর- খাগড়াছড়ি - রাঙামাটি রোডের ১১ কিলোমিটার দুরে মহালছড়ি উপজেলার মাইসছড়ি থেকে ৪ কিলোমিটার পশ্চিমে নুনছড়ি মৌজার পাহাড়ের চূড়ায় প্রায় ৬ একর জায়গা জুড়ে দেবতা পুকুরের অবস্থান, ।
স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী দেবতা কতৃক এই পুকুর খনন হয় এলাকাবাসীর তৃষ্ণা নিবারনের জন্য, ভূপৃষ্ঠ থেকে ৭০০ ফুট উচুতে প্রায় ১৭০০ সিড়ি বেয়ে দেবতা পুকুরে যেতে হয়, এখানে একটি শিব মন্দির আছে, চৈত্র-সংক্রান্তি তিথিতে এখানে বড় মেলা হয়, খাগড়াছড়ি বাসষ্টান্ড থেকে সিএনজি, পিকআপ অথবা মোটরসাইকেল যোগে দেবতা পুকুরে যাওয়া যায় ভাড়া জন প্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পড়তে পারে পানছড়ি অরণ্য কুঠির, মায়াবিনী লেক ও রাবার ড্যাম - পানছড়ি উপজেলা থেকে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে উল্টোছড়ি ইউনিয়নের শান্তিপুর নামক প্রায় ৬৫ একর জায়গা জুড়ে জঙ্গল ঘেরা স্থানে এই বৌদ্ধ ধর্মীয় চর্চাকেন্দ্রটি অবস্থিত,।এখানে দক্ষিণ এশিয়ার সব থেকে বড় ৪৮ ফুট উচু গৌতম বুদ্ধের মুর্তি রয়েছে, অরন্য কুঠির যাওয়ার পথে চেঙ্গী নদীতে সেচের জন্য নির্মিত রাবার ড্যাম দেখা যায়, মায়াবিনী লেক পানছড়ি রোডের ভাইবোনছড়া নামক স্থান থেকে ৪ কিলোমিটার পশ্চিমে ছোট বড় টিলার কোল ঘেঁসে অবস্থিত, জনপ্রতি যাওয়ার খরচ পড়তে পারে ৮০ থেকে ৯০ টাকা, সিএনজি অথবা মহেন্দ্র যোগে যাওয়া যায়।
তৈদুছড়া ঝর্ণা ও নকশী পল্লী - খাগড়াছড়ি শহর থেকে প্রায় ২০ কিঃমিঃ দুরে দীঘিনালা রোডের নয় মাইল নামক স্থানের ২ থেকে ৩ কিলোমিটার ভিতরের সীমানা পাড়ায় এই ঝর্ণার অবস্থান, ১০০ ফুট উপর থেকে পাহাড়ি ছোট ছোট সিড়ি বেয়ে ঝরে পড়া স্বচ্ছ ও শীতল পানির ঝর্ণা, পাশেই আছে ঝাপাং নামের ৮০ ফুট উচ্চতার আরো একটি ঝর্ণা, যার পানি দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে ছোট একটা হ্রদের, এছাড়া সাজেক রোডে দীঘিনালার কবাখালী আর্মি জোনের পাশে গড়ে উঠেছে নকশী পল্লী নামের একটি পার্ক, খাগড়াছড়ি শহর থেকে সিএনজি, মাহেন্দ্র ও মোটরসাইকেল যোগে এসব স্থানে যেতে জন প্রতি ১৫০/- থেকে ২০০/- টাকা খরচ হতে পারে।আলুটিলা, তারেং ও খ্রাসরাং - খাগড়াছড়ি শহর থেকে ৬ কিলোমিটার পূর্বে খাগড়াছড়ি - ঢাকা রোডে সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ৩০০০ ফুট উচ্চতায় আলুটিলা পর্যাটন পার্কের অবস্থান, এখান থেকে খাগড়াছড়ি শহরকে খুব সুন্দরভাবে দেখা যায়, আলুটিলা পাহাড়ে রয়েছে রহস্যময় গুহা যার দৈর্ঘ্য ৩৫০ ফুট, গুহার ভিতরে সূর্যের আলো না পড়ায় ভেতরটা খুবই শীতল ও ঘন অন্ধকার, এর সাথে রয়েছে একটি প্রবাহমান ঝর্ণা, এখানে টর্চ বা মোবাইলের আলো নিয়ে প্রবেশ করতে হয়, এছাড়াও আলুটিয়া আরো আছে জেলা প্রশাসন কতৃক নির্মিত ভিউ পয়েন্ট, ঝুলন্ত সেতু, পিকনিক স্পট সহ নানান স্থাপনা, আলুটিলার প্রবেশ মূল্য ২০ টাকা,।
আলুটিলার অপর পাশে রয়েছে সাংকাসনগর নামে সুন্দর একটি বৌদ্ধ মন্দির, তারেং মুলত আলুটিলার পাশের একটি পাহাড় যা সেনাবাহিনী কতৃক নিয়ন্ত্রিত এটার কোন প্রবেশ মূল্য নাই, এখানে জনপ্রিয় একটি ভিউ পয়েন্ট রয়েছে, খ্রাসরাং আলুটিলায় অবস্থিত একটি রিসোর্ট, এখানে বুনো পরিবেশে রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা আছে।রিসাং ঝর্ণা- খাগড়াছড়ির অন্যতম একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্পট হলো রিসাং ঝর্ণা, রিসাং মুলত মারমা শব্দ, রি মানে পানি আর ছাং মানে উচু স্থান থেকে গড়িয়ে পড়া, রিসাং শব্দের অর্থ হলো উচু স্থান থেকে গড়িয়ে পড়া পানি, এটি সাপমার ঝর্ণা নামেও পরিচিত, ত্রিপুরা ভাষায় এর নাম তেরাং তৈমাতাই, আলুটিলা থেকে ২ কিলোমিটার দুরে ঢাকা রোড থেকে ১ কিলোমিটার ভিতরে ইটের রাস্তা পেরিয়ে পাহাড়ি পায়ে হাঁটা পথ ও ২৩৫ টি সিড়ি পেরিয়ে এই ঝর্ণায় যেতে হয়, এই ঝর্ণার উচ্চতা প্রায় ১০০ ফুট, এর পাশে ছোট আরো একটি ঝর্ণা আছে, এখানে মাঝে মধ্যে পাহাড়ি হরিনের দেখা মেলে।
হাতির মাথা পাহাড় - খাগড়াছড়ি স্বনির্ভর স্টেডিয়াম এলাকা থেকে পশ্চিমে পেরাছড়া ইউনিয়নে অবস্থিত পাহাড়ি পথ মায়ুং কপাল পাড়া বা হাতিমুড়া নামে পরিচিত, পাহাড়টি হাতির মাথার মত দেখতে বলে স্থানীয়রা হাতির মাথা পাহাড় বলে ডাকে, প্রায় দুইশটি লোহার ধাপ বেঁয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে হয়, এ অঞ্চলের দুর্গম ১৫ টি গ্রামের লোক এই পথ ব্যবহার করে, এই পাহাড়ের চূড়ায় থেক খাগড়াছড়ি শহরকে পাখির চোখে দেখা যায়, শীতল বাতাস ও পাখির কলতান মনকে সত্যি বিমেহিত করে।এছাড়াও মাটিরাঙ্গার জল পাহাড়, শতবর্ষী বটগাছ, গুইমারা আর্মি ক্যান্টনমেন্ট, রিসাং এলাকার ঔষধি বৃক্ষের বন জার্মপ্লাজমা সেন্টার, খাগড়াপুর এলাকার পাহাড়ি কৃষি গবেষণা ইনিস্টিউট, শহরে জিরো মাইল এলাকায় জেলা পরিষদ পার্ক, ঝুলন্ত ব্রীজ, হর্টিকালচার পার্ক, নিউজিল্যান্ড পাড়া সহ অনেক আকর্ষনীয় ও বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য্যে ভরপুর পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি,খাগড়াছড়ি শহরের প্রানকেন্দ্রে থাকা ও খাওয়ার জন্য পাহাড়ী ও বাঙ্গালী মালিকানাধীন ভালো মানের অনেকগুলো হোটেল, মোটেল, রেষ্টুরেন্ট আছে, যেখানে নিরাপদে রাত্রী যাপনসহ পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ নেওয়া যায়। পরিশেষে বলা যায় শারীরিক ক্লান্তি দুর ও মানসিক প্রশান্তির বছরে একবার হলেও সুন্দর কোন স্থানে ঘুরতে যাওয়া উচিত।