সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে মিথ্যা মামলার দানব। খালকুলার গণজমায়েতকে কেন্দ্র করে দায়েরকৃত একটি বিস্ফোরক মামলায় এলাকার ১৫০ জন নিরীহ মানুষকে একসঙ্গে আসামি করে রীতিমতো হয়রানির এক ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, এটি একটি সাজানো নাটক, যার কুশীলব একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি — যিনি নিজেকে জুলাই যোদ্ধা পরিচয়ে পরিচিত করে, প্রশাসনকে ব্যবহার করে এলাকাজুড়ে ভয়ের রাজত্ব কায়েম করেছেন।
মৃত মানুষ, প্রবাসী, নারী — কেউ বাদ নেই!
এই মামলার সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় হলো — এজাহারে এমনসব মানুষের নাম রয়েছে, যারা মারা গেছেন বহু আগে, কেউ কেউ দেশে নেই বহু বছর, আবার অনেকেই নারীকর্মী, যাদের ওই ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত থাকার প্রশ্নই উঠে না। একজন প্রবাসীর বাবা বলছেন, “আমার ছেলে মালয়েশিয়ায় থাকে, বোমা মারতে কি বিমানে এসে গিয়েছিল?”
বাদীর পরিচয় ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন
মামলার বাদী মোঃ শাহিন বাবু নিজেকে একজন জুলাই যোদ্ধা পরিচয়ে উপস্থাপন করলেও, এলাকাবাসী বলছে — তিনি এই পরিচয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে পুলিশের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন বহুদিন। তাঁর বিরুদ্ধে আগেও স্থানীয় পর্যায়ে জমি দখল, হুমকি-ধামকি ও রাজনৈতিক ভয়ভীতির অভিযোগ রয়েছে।
এজাহারে বলা হয়েছে, বাদী "অসুস্থ থাকায়" মামলার জন্য দেরি করেছেন। অথচ স্থানীয়রা বলেন, মামলার ঘটনার সময় তিনি একাধিক জায়গায় সভা-সেমিনারে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, “মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে যে মামলা হয়, তা শেষ পর্যন্ত নিজের উপরই ফিরে আসে।” মামলার প্রথম সাক্ষী মোঃ মোরসালিন জানান, এ মামলা বিষয়ে আমি অবগত না, আমাকে নিয়ে বিভ্রান্ত ছড়াবেন না।
অভিযোগ: পুলিশের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও পক্ষপাত
এজাহারে বিস্ফোরক আইনের ১৪৩, ৩২৩, ৩২৪, ৩২৫, ৩২৬, ৩০৭, ৫০৬, ১১৪ ও ৩৪ ধারায় মামলা দায়ের করা হলেও, পুলিশ তদন্তে “সত্যতা পাওয়া গেছে” মর্মে মন্তব্য করেছে। অথচ তদন্তে এমন কোনো স্বাক্ষ্য, ভিডিওফুটেজ বা প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি উপস্থাপন করা হয়নি যা থেকে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়।
স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি বলেন, “তদন্ত নয়, এটা ছিল নির্দেশনা পালন। পুলিশ যেভাবে বাদীর ভাষায় কথা বলেছে, তাতে মনে হয়েছে তাঁরা কোনো নিরপেক্ষ সংস্থা নয়, বরং মামলার একতরফা বাহিনী।”
রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, সামাজিক বিভাজনের ফাঁদ?
তাড়াশের সচেতন মহল মনে করছেন, এটি নিছক কোনো ব্যক্তিগত মামলা নয় — বরং এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, জমি-বাণিজ্য ও প্রভাব বিস্তারকারী চক্রের যোগসাজশ। তারা বলছেন, এলাকার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং প্রশাসনের একটি অংশ মিলেমিশে জনগণকে দমন করার ষড়যন্ত্র করছে। মামলা দিয়ে ভয় দেখিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে স্তব্ধ করে দেওয়ার কৌশল এটিই।
একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বলেন, “জুলাই যোদ্ধা নামধারী লোকটা নিজেই এলাকার জন্য এখন আতঙ্ক। তাঁর কথায় পুলিশ চলে, মানুষ গ্রেফতার হয়। স্বাধীন দেশে এর চেয়ে বড় পরাধীনতা আর কী হতে পারে?”
বিচার না হলে মাঠে নামবে জনগণ
গণস্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করেছে মামলাটি বাতিলের দাবিতে। তারা বলছে, এই মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে যারা এজাহার দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, এবং পুলিশের নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে।
একজন ভুক্তভোগী বলেন, “মিথ্যা মামলা দিয়ে যারা পরিবারগুলো ধ্বংস করছে, তাদের আমরা ছাড় দেব না। দরকার হলে এলাকাবাসী রাস্তায় নামবে।”
এই মামলাটি শুধু ১৫০ জন নিরীহ মানুষের নয়, এটি পুরো তাড়াশবাসীর অস্তিত্বের লড়াই। পুলিশের নির্লজ্জ পক্ষপাত, প্রভাবশালীর ক্ষমতার দাপট, আর ন্যায়বিচারের নামে প্রহসনের বিরুদ্ধে এখন গর্জে উঠছে সাধারণ মানুষ।
প্রশ্ন একটাই— এই অন্যায়ের বিচার হবে তো? নাকি সত্য আর ন্যায় আবারও হার মানবে ক্ষমতার কাছে?