দলটির প্রার্থী তালিকায় এবার বিশেষ চমক রয়েছে। তা হলো-বেশিরভাগ প্রার্থীই তরুণ এবং সাবেক শিবির নেতাদের প্রাধান্য। সাবেক শিবির নেতাদের মধ্যে অন্তত ১৬ জন কেন্দ্রীয় সভাপতি রয়েছেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসা শিবির নেতাদের প্রার্থী করেছে জামায়াত।
জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশ কয়েক বছর থেকেই দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের কমিটিতে তরুণদের স্থান দেওয়া হচ্ছে। পতিত আওয়ামী ফ্যাসিবাদের জুলুম-নির্যাতন উপেক্ষা করে দলীয় কর্মকাণ্ডে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন তরুণরা। ফলে তরুণ এই নেতারা পর্যায়ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ পদে পৌঁছে গেছেন। সে ধারাবাহিকতায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রার্থী হিসেবে তরুণ নেতাদের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তরুণ আলেম ও পেশাজীবী নেতাদের পাশাপাশি শহীদ পরিবারের কয়েকজন সন্তানও প্রার্থী হচ্ছেন।
স্থানীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটাররাও এসব তরুণ প্রার্থীকে বেশ আগ্রহ ও ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করছেন বলে জানা যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা তরুণ ও নতুন প্রার্থী হওয়ায় পুরোনো কোনো অভিযোগ বা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে না তাদের। নতুন বাংলাদেশে তারা নতুন আশা জাগাচ্ছেন ভোটারদের মাঝে। এরই মধ্যে ভোটারদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন তারা। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে তাদের বিজয়ের বিষয়ে অনেকেই আশাবাদী।
তরুণ প্রার্থীদের সম্পর্কে জানতে চাইলে ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও পটুয়াখালী-২ আসনে দলীয় প্রার্থী ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে জামায়াত কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছে। একটি হলো বিগত স্বৈরাচার-ফ্যাসিবাদের নির্যাতন-নিপীড়নের মুখেও যারা অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি এবং সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যাননি। দ্বিতীয়তÑপ্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সততা, আমানতদারিতা ও যোগ্যতার প্রশ্নে যারা আপসহীন, কোনো অবস্থায়ই তারা ভোগের রাজনীতিতে ব্যবহার হবেন না। তৃতীয়ত—যারা জনগণের কাছাকাছি থেকেছেন, জনগণের ভালোবাসার সমর্থন নিয়ে যারা সামনে এগিয়ে যেতে পারবেন। এসব দিক বিবেচনা করে জামায়াতের পক্ষ থেকে স্থানীয় চাহিদার আলোকে তরুণ বা ছাত্রশিবিরে নেতৃত্ব দিয়ে আসাদের প্রার্থী করা হয়েছে।
জামায়াতের এই নেতা আরো বলেন, এখন জামায়াত আমির ও সেক্রেটারি জেনারেল থেকে শুরু করে বেশিরভাগ ইসলামী ছাত্রশিবির থেকে আসা নেতৃত্ব। সে হিসেবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়ই আমাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ। আর কেউ চাইলেই তার নিজের ইচ্ছামতো এখানে আসতে পারেন না। এখানে একটি বাছাই প্রক্রিয়া ও নিয়ম আছে।
ব্যতিক্রম দু-একজন ছাড়া সবাইকে তৃণমূল থেকেই পর্যায়ক্রমে উঠে আসতে হয়েছে। মাঠপর্যায়ে তরুণ প্রার্থীরা ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন জানিয়ে ড. মাসুদ বলেন, শুধু এখন নয়; বিগত ১৭ বছর জনগণের সাড়া পেয়েছি বলেই এত নির্যাতন-নিপীড়নের পরও আল্লাহর রহমতে আমরা এ অবস্থানে আছি। ফ্যাসিবাদের কাছে মাথানত না করার কারণে জনগণের কাছে ভালোবাসা বেড়েছে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী ভালো সময়েও আমাদের নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো অন্যায়-অপরাধের অভিযোগ নেই। জামায়াত নেতাদের এই ক্লিন ইমেজ সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত আগ্রহ তৈরি করেছে। বিশেষ করে জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন কিছু চাওয়ার জায়গায় জামায়াতের প্রতি আস্থা বেড়েছে। তা ছাড়া নতুন ও তরুণ প্রার্থীদের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি, অপেক্ষাকৃত চ্যালেঞ্জ কম এবং নতুন কিছু দেওয়ার প্রতিশ্রুতির কারণে তরুণ এবং প্রবীণ নেতাদের সমন্বয়ে আগামী নির্বাচনে জনগণ চাইলে জামায়াত ক্ষমতায় যাবে।
জামায়াত সূত্রে জানা যায়, সিলেট মেডিকেলের শিক্ষার্থী থাকাবস্থায় ১৯৭৭ সালে ছাত্রশিবিরে যোগ দেন জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি প্রথমে ওই মেডিকেলের শিবিরের সভাপতি ও পরবর্তীতে সিলেট শাখার সভাপতি ছিলেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা-১৫ আসনে দলীয় প্রার্থী করা হয়েছে তাকে। এ ছাড়া নিজ এলাকা মৌলভীবাজার-২ আসনেও তার প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
একই ভাবে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার। বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের ধারাবাহিকতায় ১৯৮৪-৮৫ সেশনে শিবিরের খুলনা মহানগরীর সেক্রেটারি ছিলেন তিনি। আগামী নির্বাচনে খুলনা-৫ আসনে নির্বাচন করবেন সাবেক এই এমপি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের প্রথম সভাপতি ছিলেন জামায়াতের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল, বর্তমানে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এটিএম আজহারুল ইসলাম। আগামী নির্বাচনে রংপুর-২ আসনে তাকে প্রার্থী করা হয়েছে। এ ছাড়া শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ কক্সবাজার-২ আসনে প্রার্থী হচ্ছেন।
শিবিরের সাবেক যেসব সভাপতিকে জামায়াত আগামী নির্বাচনের জন্য প্রার্থী করেছে, তারা হলেনÑদলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন ঢাকা-১২, নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের কুমিল্লা-১১, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান সিরাজগঞ্জ-৪, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ ময়মনসিংহ-৫, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম বুলবুল চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন সিলেট-৬, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ পটুয়াখালী-২, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তরের সেক্রেটারি ড. রেজাউল করিম লক্ষ্মীপুর-৩, ঢাকা মহানগর উত্তরের সহকারী সেক্রেটারি ডা. মোহাম্মদ ফখরুদ্দিন মানিক ফেনী-৩, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি দেলাওয়ার হোসেন ঠাকুরগাঁও-১, নারায়ণগঞ্জ মহানগর আমির মাওলানা আব্দুল জব্বার নারায়ণগঞ্জ-৪, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান ঢাকা-১১, ঢাকা মহানগর উত্তরের সহকারী সেক্রেটারি মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত কুমিল্লা-১০, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের অফিস সম্পাদক ড. মোবারক হোসাইন কুমিল্লা-৫, গাজীপুর সদর মেট্রো থানা আমির সালাহউদ্দিন আইউবী গাজীপুর-৪ এবং ২০২২ সেশনে শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের ধানমন্ডি থানা আমির হাফেজ রাশেদুল ইসলাম শেরপুর-১।
ঢাকার ২০টি আসনেই জামায়াতের তরুণ নেতাদের প্রার্থী করা হয়েছে, যাদের প্রায় সবাই ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। দুজন কেন্দ্রীয় সভাপতি ছাড়াও ঢাকা-১ আসনে শিবিরের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার নজরুল ইসলাম, ঢাকা-১০ আসনে সাবেক কার্যকরী পরিষদ সদস্য ও চাকসুর ভিপি অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার, সাবেক কার্যকরী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নায়েবে আমির অ্যাডভোকেট হেলাল উদ্দিন ঢাকা-৮ আসনের প্রার্থী হচ্ছেন। ঢাকা-৫ আসনে সাবেক কার্যকরী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি মোহাম্মদ কামাল হোসেন এবং ঢাকা-৬ আসনে প্রার্থী হচ্ছেন ইবি শাখার সাবেক সভাপতি ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি ড. আব্দুল মান্নান। ঘোষিত বাকি প্রার্থীরাও শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে জানা গেছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, শিবিরের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট শিশির মনির সুনামগঞ্জ-২, সাবেক কার্যকরী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তরের তুরাগ থানা জামায়াতের আমির মো. মতিউর রহমান দিনাজপুর-১, সাবেক কার্যকরী পরিষদ সদস্য মাওলানা ওবায়দুল্লাহ খান সালাফী নীলফামারী-৩, অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বেলাল রংপুর-৩, রাবি শাখার সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আবু তালেব মণ্ডল পাবনা-৪, ইবি শাখার সাবেক সভাপতি ও ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি মাহফুজুর রহমান নওগাঁ-৩, ইবি শাখার সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মাসুদ পারভেজ রাসেল চুয়াডাঙ্গা-১, কার্যকরী পরিষদ সদস্য অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান খুলনা-৩ আসনে প্রার্থী হচ্ছেন।
শিবিরের সাবেক কার্যকরী পরিষদ সদস্য ও রাবি শাখার সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব আলম সালেহী কুড়িগ্রাম-৩, সাবেক কার্যকরী পরিষদ সদস্য নিজামুল হক নাইম ভোলা-৪, শেখ নেয়ামুল করিম ঝালকাঠি-২, সাবেক ঝিনাইদহ জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল আউয়াল জামালপুর-৪, সাবেক কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের প্রচার সম্পাদক আতাউর রহমান সরকার ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ এবং ঢাবি শাখার সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট শাহ মুহাম্মদ মাহফুজুল হককে নোয়াখালী-৬ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
শহীদ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সাবেক আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমান মোমেন পাবনা-১ আসন, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে শামীম সাঈদী পিরোজপুর-২, মাসুদ সাঈদী পিরোজপুর-১, মীর কাসেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আরমান ঢাকা-১৪ আসনে প্রার্থী হচ্ছেন। কুষ্টিয়া-৩ আসনে প্রার্থী করা হয়েছে তরুণ বক্তা মুফতি আমির হামযাকে।
জামায়াতের প্রার্থী তালিকায় তরুণ ও সাবেক শিবির নেতাদের প্রাধান্য পাওয়া প্রসঙ্গে সংগঠনটির সাবেক কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক, জামায়াতের ঢাকা মহানগর উত্তরের প্রচার সম্পাদক ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনের তরুণ প্রার্থী আতাউর রহমান সরকার বলেন, এ যুগ তরুণদের যুগ, জেন-জির যুগ। তারা পরিবর্তন চাইছে, নতুন বন্দোবস্ত চাইছে। একই সঙ্গে তারা সৎ, যোগ্য ও আল্লাহভীরু নেতৃত্ব দেখতে চায়। তরুণদের বক্তব্য হলো—৫৪ বছরে যারা পারেননি, নতুন করে তাদের দেখার কী আছে? এজন্য জামায়াত সে ধরনের নেতৃত্ব ও প্রার্থী মূল্যায়ন করেছে। জামায়াতের প্রায় ৭০ ভাগ প্রার্থীর বয়স ৫০ বছরের নিচে এবং মাঠপর্যায়ে তরুণ প্রার্থীরা ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন।