রোকেয়া দিবস উপলক্ষ্যে গত শুক্রবার সন্ধায় প্রগতি লেখক সংঘ, সুনামগঞ্জ জেলা আয়োজন উক্ত আলোচনা সভা। শহিদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরিতে আলোচনা সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় প্রগতি লেখক সংঘ সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি নির্মল ভট্টাচার্যের সভাপতিত্ব মুখ্য আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ,বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. রোখসানা চৌধুরী (রোকেয়া গবেষক )।

এছাড়াও উক্ত সভায় আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেন, সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ প্রফেসর রজত কান্তি সোম মানস, ইংরেজী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জনাব ইভা রায়,কবি ও প্রাবন্ধিক ইকবাল কাগজী,সাংবাদিক শামস শামিম,গণিত শিক্ষক অনুপ নারায়ণ রোমেল প্রমুখ। আলোচনায় আলোচক বৃন্দ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এখনো রোকেয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করেন তারা মনে করেন সমাজের ৯০ভাগ নারী আজো দাসত্বের শিকার! নারী মুক্তির জন্য রোকেয়ার সংগ্রামের কথা সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তারা। তবে অনুষ্ঠান যাদের মুক্তির জন্য সেই নারীরাই আসলে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না যা মহৎ এই আয়োজনকে কিছুটা হলেও অমলিন করে।   

নারী জাগরণ ও নারী অধিকার  আন্দোলনের পথিকৃৎ ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। মুক্তচিন্তা,ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং শাণিত লেখনীর দিয়ে রোকেয়া বিশ শতকের একজন বিরল ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। বিশ শতকের প্রথম দিকে বাঙালি মুসলমানদের নবজাগরণের সূচনালগ্নের আলোন্দলনে তিনিই ছিলেন নেতৃত্বদানকারী। তিনি ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।নারী জাগরণের এই অগ্রদূত বেঁচেছিলেন মাত্র বায়ান্ন বছর। এই সময়েই তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন, সর্বত্র আলোড়িত হয়েছিল নারী সমাজ।প্রতি বছর বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে ৯ ডিসেম্বর পালিত হয় রোকেয়া দিবস। নারী জাগরণের বিভিন্নক্ষেত্রে অবদানের জন্য প্রতিবছর সরকারিভাবে প্রদান করা হয় রোকেয়া পদক। আলোচনায় রোকেয়া গবেষক ড. রোখসানা চৌধুরী আজকের বিশ্বে বিষ্ময়করভাবে সাযুজ্যপূর্ণ রূপরেখা দেখানোর জন্য তাঁর( রোকেয়া) প্রধান প্রধান গ্রন্থকে বিশ্লেষণের আওতায় নিয়ে এসেছেন( সুলতানার স্বপ্ন,পদ্মরাগ,অবরোধবাসিনী)।

তাঁর ( রোখসানা চৌধুরী) রচিত 'আজকের  বাংলাদেশে রোকেয়ার প্রাসঙ্গিকত' থেকে চমক অংশ আলোচনা করেন। সেখান থেকেই জানা যায়,এই পুরুষতান্ত্রিক কঠোরতা এবং একই সঙ্গে প্রকৃতিলগ্ন নারীসত্তার পরস্পরবিরোধী হলেও রোকেয়ার রোকেয়ার কল্পনায় এদের যুগপৎ সহাবস্থান দেখতে পাওয়া যায়। পুঁজিবাদের তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতির একটি মূল শর্ত হলো মানুষের মনে অসন্তোষ জাগিয়ে রাখা। রোকেয়া সেই প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখার আপ্ত বিষয়টিকে অতিহিংসা অভিধায় অভিহিত করে। বরণ করে নিতে চাইলেন শতাব্দীজয়ী পৃথিবীর মানচিত্র বদলে দেওয়া " সোশ্যাল ডারউইনিজম" নীতিকে, যার মূল কথা ছিল survival of the। সেখানেও প্রতিযোগিতা আছে। কিন্তু এই প্রতিযোগিতাকে সেখানে একটি ইতিবাচক কাজের মধ্যে পরিচালিত করা হয়েছে। কেউ ভাল কাজ করলে অন্যরাও অতিহিংসার বশবর্তী হয়ে আরো ভাল কাজে নিয়োজিত হয়। হিংসাকে একটি শক্তিতে রূপান্তর করা হয়েছে। তিনি জানান রোকেয়া বর্ণিত সুতানার স্বপ্নরাজ্যের অধিকাংশ স্বপ্নই আজ বাস্তবায়নের পথে। নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে আশানুরূপ সফলতা লাভ না করলেও যে- কোনো ধরনের কাজেই তার ( নারী) পারঙ্গমতা,সক্ষমতা,দক্ষতার নজির রেখেছে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন নারীকে মাতৃত্ববিষয়ক অধিকাংশ দুর্ভোগকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। শুধু তা-ই নয়, টিউবে সংরক্ষিত পুরুষের স্পার্ম ব্যবহার করে নারী এখন সত্যিকার অর্থে ' একক মাতৃত্ব' গ্রহণে সক্ষমতা লাভ করেছে। সুলতানার স্বপ্ন কোনো স্বপ্ন নয়, উপমহাদেশের প্রথম নারীবাদী রচয়িতার প্রণীত নারীর ক্ষমতায়নের অনন্য রূপরেখা। তিনি আরো জানান রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এই উপমহাদেশের প্রথম নারীবাদী,যিনি ধর্ম ও পুরুষতন্ত্রকে আক্রমণ করেছিলেন একই সঙ্গে।কোনো বিশেষ ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থকে নয়,বরং সকল ধর্ম ও তার ধারক-বাহক-প্রহরীরূপী পুরুষকে। অথচ তাঁর নাম নিয়েই ঘটে গেছে সবচেয়ে বড়ো বিভ্রাট। উপমহাদেশের প্রথম নারীবাদীর নামের তিন-চতুর্থাংশই কৃত্রিমভাবে আরোপিত।

পিতৃপ্রদত্ত নামটি ছিল মোসাম্মৎ রুকাইয়া খাতুন।বিয়ের পর তিনি মিসেস আর.এস.হোসেন নামে লিখতে শুরু করেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বিদ্রোহী সত্তাকে আড়াল করে একজন ' সম্ভ্রান্ত মুসলিম ভদ্রমহিলা'র অবয়ব প্রদানের অভিপ্রায়ে' বেগম রোকেয়া' নামে তাঁকে পরিচিতি কর হয়। বর্তমানে ' বেগম রোকেয়া' এবং ' রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন'- দুটি নামই জনসমাজে প্রচলিত,যার একটি নামও তাঁর প্রকৃত পরিচয় বহন করে না। নামজনিত এই বিভ্রাট অত্র অঞ্চলের অবিকশিত,বিভ্রান্ত নারীবাদী ভাবনার প্রতীক হয়ে ধরা দেয়।' রোকেয়া'- পরবর্তী দীর্ঘ শূন্যতার প্রেক্ষাপট স্পষ্ট হয়ে ওঠে।