ভাঙা ঘরেও ভালো থাকার স্বপ্ন দেখতেন রূপলাল রবিদাস (৪০)। ছেলেকে পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষ করার স্বপ্ন ছিল তার। ছেলে প্রতিষ্ঠিত হলে সংসারের হাল ধরবে, দূর হবে অভাব-অনটন। সত্যিকারের আলোয় ভালো থাকার হাসিতে বাঁচবে পুরো পরিবার। কিন্তু সেই স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে রূপলালের মৃত্যুতে। চোর সন্দেহে মব সৃষ্টি করে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয় রূপলাল রবিদাস ও তার ভাগ্নিজামাই প্রদীপ লাল রবিদাসকে।


রূপলালের মৃত্যুর সঙ্গে নিভে গেছে তার পরিবারের স্বপ্ন দেখার শক্তি। আলোহীন ঘরে অশ্রুসিক্ত পরিবারের ভরসা এখন ১৪ বছরের স্কুলপড়ুয়া জয় রবিদাস। তাইতো স্কুল ছেড়ে ফুটপাতে ছোট্ট কাঠের চৌকিতে বসে জুতা সেলাই করতে হচ্ছে তাকে। যেখানে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বসতেন রূপলাল, সেই শূন্য আসনই এখন ছেলে জয়ের ঠিকানা।

জয় রবিদাস রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর গ্রামের রূপলাল রবিদাসের ছেলে। সে তারাগঞ্জ সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র। স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। বাবাকে হারিয়ে সেই স্বপ্ন থেমে গেছে তার। সংসারের ভার কাঁধে নিয়ে বাধ্য হয়ে স্কুল ছেড়ে নামতে হয়েছে পৈতৃক পেশায়।

তারাগঞ্জ বাজারে নতুন চৌপথী বাসস্ট্যান্ড থেকে অগ্রণী ব্যাংক মোড়ের মধ্যবর্তী স্থান জুতাপট্টির সামনের রাস্তার পাশে জলচৌকিতে বসে এখন জুতা সেলাইয়ের কাজ করছে সে। পাশে যন্ত্রপাতি, সামনে কয়েক জোড়া জুতা। প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত জুতা সেলাই ও রং (পালিস) করছে। তবে সে বাবার মতো জুতা তৈরি করতে পারে না।

এখন ছোট্ট এই জয় পরিবারের হাল ধরার লড়াইয়ে জিততে চায়। বিচার চায় তার বাবার হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের। আর যেন কাউকে মব সন্ত্রাসে প্রাণ হারাতে না হয়, সে দাবিও তার মুখে।

টলমল চোখে জয় বলে, বাবার পেশাকেই নিজের পেশা হিসেবে নিতে হলো। বাড়িতে আমার দাদি, মা ও দুই বোন রয়েছে। তাদেরকে দেখাশোনার ও ভরণপোষণের দায়িত্ব এখন আমার ওপর। বাবা বেঁচে থাকলে আমাকে হয়তো এত তাড়াতাড়ি এই কাজে আসতে হতো না। বাবাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মেরে ফেলায় আমরা এতিম হয়ে গেছি। আমার পড়াশোনা হবে কিনা জানি না, তবে দুই বোনকে পড়াতে চাই।

জয়ের কাছে জুতা পালিস করতে আসা অনেকে তাকে সমবেদনা জানান। পার্শ্ববর্তী দোকানদাররা বলেন, রূপলাল দাস নিরীহ মানুষ ছিলেন। দীর্ঘদিন বাজারে মুচির কাজ করেছেন। কিন্তু কারও সঙ্গে কখনো ঝগড়া-বিবাদে জড়াননি। সহজ-সরল এই মানুষটাকে পিটিয়ে হত্যা করে তার পরিবারকে পথে বসাল। স্কুল যাওয়া বাদ দিয়ে জয় এখন জুতা সেলাই করছে। দুঃখ লাগছে ওকে দেখে।

রূপলালের বড় মেয়ে নুপুর রবিদাস তার বাবার মৃত্যুর ঘটনা তুলে ধরে বলেন, আমার বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করার কথা। এ জন্য প্রদীপ দাদা আমাদের বাড়িতে আসতে ছিলেন। রাস্তা না চেনায় বাবা-দাদাকে কাজীরহাট থেকে আনতে যায়। সেখান থেকে প্রদীপের ভ্যানে চড়ে বাড়ি ফেরার পথে বটতলায় লোকজন আটক করে মারধর করেন। খবর পেয়ে রাতে বুড়িরহাট গিয়ে বাবা-দাদার রক্তাক্ত দেহ শনাক্ত করি। এইভাবে মানুষ মারা—এটা অমানবিক। বাবাই ছিলেন আমাদের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাকে হারিয়ে আমাদের পুরো পরিবার আজ দিশেহারা।

নুপুর আরও বলেন, বাবা বেঁচে থাকলে ছোট ভাইকে স্কুল ছেড়ে ফুটপাতে জুতা সেলাইয়ের কাজ করতে হতো না। ছোট ভাইয়ের রোজগারে সংসার চলছে-এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় দুঃখ। যদি উপায় থাকতো তাহলে জয়কে কাজ করতে যেতে দিতাম না।

জয়ের মা ভারতী রানী রবিদাস বলেন, সংসারে আর কোনো পুরুষ নেই, জয়-ই এখন একমাত্র ভরসা। কতটুকু আয় করতে পারবে জানি না, তবে সেই আয়ে আমাদের কোনোভাবে বাঁচতে হবে। ছেলেটাকে স্কুলে পাঠাতে না পেরে বুক ফেটে যাচ্ছে। কিছু মানুষ আমাদের সুখ-শান্তি চিরদিনের জন্য কেড়ে নিয়েছে।

উল্লেখ্য, তারাগঞ্জ বাজারে রূপলাল রবিদাস জুতা সেলাই করতেন। গত ৯ আগস্ট (শনিবার) দিবাগত রাত সাড়ে ৮টার দিকে মিঠাপুকুরের ছড়ান বালুয়া এলাকা থেকে ভাগ্নিজামাই প্রদীপ লাল রবিদাসকে নিয়ে ভ্যানে করে বাড়ি ফেরার পথে সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বটতলা মোড়ে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি তাদের পথরোধ করে চোর সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এরই একপর্যায়ে সন্দেহভাজনরা প্রদীপ লালের কালো ব্যাগ তল্লাশি করে ‘স্পিড ক্যানের’ বোতলে দুর্গন্ধযুক্ত পানীয় এবং কিছু ওষুধ পান। বোতলের ঢাকনা খোলার পর দুর্গন্ধে বুড়িরহাট এলাকার মেহেদী হাসানসহ কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে উত্তেজিত হয়ে রূপলাল ও প্রদীপ লালকে বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে মাঠে নিয়ে যান।

এর পরই মব গড়ে উঠলে সেখানে লাঠিসোঁটা ও লোহার রড দিয়ে তাদের দুজনকে বেধড়ক মারধর করা হয়। একপর্যায়ে গুরুত্বর আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক রূপলাল রবিদাসকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে সেখান থেকে প্রদীপ লাল রবিদাসকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির জন্য পাঠানো হয়। পরদিন রোরবার ভোরে প্রদীপ লালেরও মৃত্যু হয়।