বাংলাদেশ ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ট্রলের শিকার হয়েছেন কোন ক্রিকেটার? পরিসংখ্যান নেই। তাই চাইলেই যে কারও নাম বলে দেওয়া যায় না। তবু চিন্তাভাবনা করে যদি কয়েকটি নাম বাছাই করেন, সেখানে একটি নাম ‘কমন’ পড়তে পারে—নাজমুল হোসেন। ব্যঙ্গ, কটাক্ষ, মিম—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব ব্যাপারে মেধা বিনিয়োগে বেশ ভালো ‘পুঁজি’ ছিলেন নাজমুল।ছিলেন? না, এখনো কিছুটা আছেন। তবে ট্রলের মাত্রা বেশ কমেছে। হতে পারে সেটা নাজমুলের পারফরম্যান্সের কারণে। কিংবা রোমান্টিক সিনেমার গল্পের মতোও হতে পারে—বিরাগ থেকে যেভাবে অনুরাগ তৈরি হয়।

বাংলাদেশ ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ট্রলের শিকার হয়েছেন কোন ক্রিকেটার? পরিসংখ্যান নেই। তাই চাইলেই যে কারও নাম বলে দেওয়া যায় না। তবু চিন্তাভাবনা করে যদি কয়েকটি নাম বাছাই করেন, সেখানে একটি নাম ‘কমন’ পড়তে পারে—নাজমুল হোসেন। ব্যঙ্গ, কটাক্ষ, মিম—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব ব্যাপারে মেধা বিনিয়োগে বেশ ভালো ‘পুঁজি’ ছিলেন নাজমুল।ছিলেন? না, এখনো কিছুটা আছেন। তবে ট্রলের মাত্রা বেশ কমেছে। হতে পারে সেটা নাজমুলের পারফরম্যান্সের কারণে। কিংবা রোমান্টিক সিনেমার গল্পের মতোও হতে পারে—বিরাগ থেকে যেভাবে অনুরাগ তৈরি হয়।


ক্রিকেটাররা কেন ট্রলের শিকার হন? উত্তরটা বেশি কঠিন নয়। সহজ কথায়, পারফরম্যান্স না করলে। অন্য কারণও থাকতে পারে, তবে পারফর্ম করলে দিন শেষে সবাই ক্রিকেটারদের গুণগান গাইতে বাধ্য। তাহলে কী নাজমুল পারফর্ম করতে পারেননি? গতকাল বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করে ম্যাচ জেতানো অধিনায়ক নাজমুলের ওয়ানডে পারফরম্যান্সে চোখ দেওয়া যাক।

নাজমুলের পারফরম্যান্সে যাওয়ার আগে দেশের ক্রিকেটে ওয়ানডে সেঞ্চুরির একটা পরিসংখ্যান জেনে রাখা ভালো। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির মালিক তামিম ইকবাল—১৪টি। তামিম ছাড়া অন্য কোনো ক্রিকেটারের ১০টি সেঞ্চুরিও নেই। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির মালিক সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিম—দুজনেরই সমান ৯টি সেঞ্চুরি।

এর পরের নামটা লিটন দাসের। তাঁর সেঞ্চুরির সংখ্যা ৫। বাংলাদেশ ক্রিকেটে একসময়ের বড় তারকা মোহাম্মদ আশরাফুলের ওয়ানডে সেঞ্চুরি ৩টি। অর্থাৎ দেশের ক্রিকেট ইতিহাস বিবেচনায় ৩টি ওয়ানডে সেঞ্চুরি একদম ছোটখাটো কোনো অর্জন না। গতকাল ওয়ানডে ক্যারিয়ারে নিজের তৃতীয় সেঞ্চুরিই তুলে নিয়েছেন নাজমুল।

তৃতীয় সেঞ্চুরির দেখা পেতে নাজমুলের লেগেছে ৪২ ইনিংস। ৪২ ইনিংসে ৩ সেঞ্চুরি—এই ‘কনভারশন রেট’ ভালো না খারাপ? এই উত্তর খোঁজার আগে একবার মনে করিয়ে দেওয়া ভালো, ক্রিকেটে বাংলাদেশি মান এবং আন্তর্জাতিক মানের মধ্যে তফাত আছে।

ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে ন্যূনতম ২টি সেঞ্চুরি করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ৪০–এর বেশি ব্যাটিং গড় কারও নেই। সর্বোচ্চ গড় সাকিবের—৩৭.২৯। তামিমের গড় ৩৬.৬৫, আর মুশফিকের ৩৬.৮। কিন্তু বিশ্ব ক্রিকেটে টপ অর্ডার ও মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের ওয়ানডেতে ৪০–এর বেশি গড় থাকাটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। সাকিব, তামিম, মুশফিককে দেশসেরা ব্যাটসম্যান বলেই বিবেচনা করা হয়। তাই নাজমুলকে বাংলাদেশি মানদণ্ডে অর্থাৎ সাকিব-তামিমদের সঙ্গে তুলনা করাই যায়।

ব্যাট হাতে বাংলাদেশি মানের সেরা উদাহরণ সাকিব-তামিম-মুশফিকই। এদের সঙ্গে মাহমুদউল্লাহর নামটাও যোগ করা যেতে পারে। এই চার ক্রিকেটার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম ৩ সেঞ্চুরি কততম ম্যাচে এসে পেয়েছেন?

১৩৬ ইনিংস
তৃতীয় ওয়ানডে সেঞ্চুরি পেতে মুশফিকুর রহিমের অপেক্ষা

ওপেনার তামিমকে তৃতীয় ওয়ানডে সেঞ্চুরি পেতে খেলতে হয়েছে ৭৪ ইনিংস। ক্যারিয়ারের পঞ্চম ম্যাচে বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে অনবদ্য ৫১ রানের ইনিংস খেলা তামিমের ব্যাট এরপর অনেক দিন নিশ্চুপ ছিল। প্রথমবার তিনি তিন অঙ্কের ঘরে পৌঁছান ২৭তম ইনিংসে। প্রথম সেঞ্চুরির আগে খেলা ২৬ ইনিংসের মধ্যে ১৫ বারই ২০ রানের কমে আউট হন এই ওপেনার।

মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান সাকিব প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি করেন ক্যারিয়ারের ১৯তম ইনিংসে। মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে সাকিবের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের শুরুটা খুব একটা খারাপ ছিল না। ১৯তম ইনিংসে সেঞ্চুরি পাওয়ার আগে খেলা ১৮ ইনিংসের মধ্যে ৬টিতেই অপরাজিত ছিলেন সাকিব। ফিফটি ছিল দুই ম্যাচে। সাকিব ক্যারিয়ারের তৃতীয় সেঞ্চুরি পান ৬৪তম ইনিংসে।

মুশফিকুর রহিম তৃতীয় ওয়ানডে সেঞ্চুরি পেয়েছেন ১৩৬তম ইনিংসে। এই উইকেটকিপার ব্যাটসম্যানের ক্যারিয়ারের শুরুটা মোটেই সহজ ছিল না। ক্যারিয়ারের প্রথম ৫০টি ওয়ানডে ইনিংসের মধ্যে ১৮টিতেই তিনি আউট হন এক অঙ্কের ঘরে। ৪টিতে এক অঙ্কের ঘরে অপরাজিত ছিলেন। যদিও শুরুর দিকে তাঁর ব্যাটিং অর্ডার পেছনের দিকে ছিল, তবুও ৫০ ইনিংসের মধ্যে ১৮ বার ১০ রানের ঘরও পার করতে না পারার ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যাটিং অর্ডারকে দাঁড় করানো যায় না।

মাহমুদউল্লাহ শুরুর দিকে বেশির ভাগ ম্যাচে ব্যাটিং করেছেন লোয়ার অর্ডারে। শুরুতে তিনিও খুব একটা খারাপ করেননি। ৯৮তম ইনিংসে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথম সেঞ্চুরি করা মাহমুদউল্লাহ ক্যারিয়ারের ১২৫তম ইনিংসে তৃতীয় সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন। মোহাম্মদ আশরাফুলও মুশফিকের মতো ১৩৬তম ইনিংসে তৃতীয় সেঞ্চুরি পেয়েছেন।

তামিম-মুশফিকের ব্যাটিং রেকর্ডে একটা ধারা আছে—দুজনই শুরুর দিকে কঠিন সময় পার করেছেন। ক্যারিয়ারের সেরা সময় এসেছে বেশ কয়েক বছর পর। সাকিব-মাহমুদউল্লাহর শুরুটা মোটামুটি ভালো হলেও নিজেদের সেরাটায় পৌঁছেছেন আরও অনেক পরে। এদের নিজেদের সেরাটা পর্যন্ত পৌঁছাতে কারও লেগেছে ৫ বছর, কারও ৬ বছর, কারও আরও বেশি। এই যেমন তামিম, ২০১৫ সালের আগপর্যন্ত ব্যাট হাতে ১৩৪ ইনিংস খেলেছেন। তখন তাঁর গড় ৩০–ও ছিল না—২৯.৮৫। এরপর তিনি ব্যাটিং করেছেন ৪৬.১৬ গড়ে। স্ট্রাইকরেটও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৭ থেকে ৭৯।

২০১৫ সালের আগপর্যন্ত মুশফিকুর রহিম খেলেছেন ১২৯ ইনিংস। গড় ২৮.৯২, স্ট্রাইকরেট—৭১.৩৫। তাঁরও সেরাটা এসেছে ২০১৫ সাল থেকেই। এই সময়ে খেলা ১২২ ইনিংসে তিনি ব্যাটিং করেছেন ৪৫.৩১ গড় আর ৮৬. ৫৫ স্ট্রাইকরেটে।

সেদিক থেকে নাজমুল খানিকটা কম সময়ই নিয়েছেন। পরিসংখ্যান সেটাই বলছে। ১৬তম ইনিংসে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথম ফিফটি করা নাজমুল ২২তম ইনিংসে পেয়েছেন সেঞ্চুরি। এরপর বাকি ২০ ইনিংসে সেঞ্চুরি আছে আরও দুটি। নাজমুলের ৩টি সেঞ্চুরির প্রথমটি এসেছে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে, তাদের মাটিতে। বাকি দুটো আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বোলিং লাইন-আপকে দুর্বল বলার সুযোগ নেই। যদি ভেবে থাকেন, নাজমুল দুর্বল আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছেন—সেটা হয়তো ঠিক। তবে এ প্রসঙ্গে কিছু তথ্য মনে করিয়ে দেওয়া ভালো। সাকিব তাঁর প্রথম সেঞ্চুরি করেছিলেন কানাডার বিপক্ষে, তামিম আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। মুশফিকের প্রথম সেঞ্চুরি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।

লিটন এদের চেয়ে অনেক কম ম্যাচে তিন সেঞ্চুরির মালিক হয়েছিলেন। মাত্র ৩৬তম ইনিংসে তিন নম্বর সেঞ্চুরি করেছেন লিটন, যা মুশফিকের চেয়ে ১০০টি ইনিংস কম।

তামিম-মুশফিকদের ভাগ্যবানই বলতে হবে। তাঁদের ক্যারিয়ারের শুরুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দাপট ছিল না। ভয়ংকর সব ট্রল ও কটাক্ষের শিকার হতে হয়নি, যেটা নাজমুলরা হয়েছেন, ফর্ম পড়তির দিকে গেলে নিঃসন্দেহে আবারও হবেন।

পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, তামিম–মুশফিকদের চেয়ে ক্যারিয়ারটা ভালোভাবে শুরু করেছেন নাজমুল। এখন এটা ধরে রাখার পালা। তামিম মুশফিকরা যেভাবে ২০১৫ সালের পর ওয়ানডেতে পারফর্ম করেছেন, নিঃসন্দেহে তেমন কিছুই করতে চাইবেন বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল। কিংবা তার চেয়েও ভালো কিছু এবং সেটাই স্বাভাবিক। ব্যাটসম্যান হিসেবে সাকিব-তামিমরা যে বাংলাদেশি মান তৈরি করেছেন, সেটাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তো এই প্রজন্মেরই।(সূত্র;প্রথম আলো)