নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলায় সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণি রয়েছে এমন কলেজ আছে ৫টি। যার মধ্যে ১টি সরকারি, ৩টি এমপিওভুক্ত বেসরকারি ও ১টি নন-এমপিও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি সমমানের আলিম শ্রেণি আছে এমন মাদ্রাসা রয়েছে ৮টি। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি বিএমটি শাখা চালু আছে এমন প্রতিষ্ঠান ২টি। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০২২ সালের বার্ষিক শিক্ষা জরিপের প্রদত্ত তথ্য অনুসারে, ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে এইচএসসিতে সাধারণ ৫টি কলেজে মোট শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল ২ হাজার ৫৭৮ জন, আলিম শ্রেণিতে ৮টি মাদ্রাসায় ভর্তির এই সংখ্যা ৪৫২ এবং এইচএসসি (বিএমটি) শাখায় ২টি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছিল ২৩০ জন শিক্ষার্থী। সবমিলিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ভর্তির এই সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ২৬০। পরবর্তী সময়ে এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে উপজেলার বাইরে অন্য প্রতিষ্ঠানে ট্রান্সফার ইন কিংবা ট্রান্সফার আউট হয়েছে এই সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। কলেজগুলোতে ভর্তিকৃত মোট শিক্ষার্থীর ৬৩ ভাগ, মাদ্রাসাগুলোতে ভর্তিকৃত মোট শিক্ষার্থীর ৬২ ভাগ, কারিগরির বিএমটিতে ভর্তি হওয়া ৪২ ভাগ; সব মিলিয়ে মোট শিক্ষার্থীর ৬১ ভাগের বেশিই নারী শিক্ষার্থী। এই সেশনে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরাই আগামী ১৭ আগস্ট থেকে শুরু হতে যাওয়া চলতি ২০২৩ সালের উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ফরম পূরণের সময় ১৯ জুলাই শেষ হলেও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, কুমিল্লা এবং বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের বিলম্ব ফিসহ ফরম পূরণের শেষ সময় ছিল ২৫ জুলাই।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে এই সময়ে কলেজগুলোতে এইচএসসির ফরম পূরণ করেছেন মোট ১ হাজার ৭১৫ জন, মাদ্রাসাগুলোতে আলিম শ্রেণির ফরম পূরণ করেছে ২৮৪ জন এবং কারিগরির দ্বাদশ শ্রেণির বিএমটিতে ফরম পূরণ করেছে ১৩৬ জন শিক্ষার্থী। তিনটি বোর্ড মিলিয়ে এই সংখ্যা মোট ২ হাজার ১৩৫। যেখানে ৬২ ভাগই নারী শিক্ষার্থী। ফরম পূরণের এই সংখ্যা মোট ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীর সাড়ে ৬৫ শতাংশ। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে আবার বিগত ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের আগে ভর্তি হওয়া অনিয়মিত শিক্ষার্থীও রয়েছে। একাদশ শ্রেণিতে এইচএসসি, আলিম ও বিএমটিতে ভর্তি হওয়া বাকি মোট ১ হাজার ১২৫ জন শিক্ষার্থীর প্রায় সবাই ঝরে গেছেন। যা মোট সংখ্যার সাড়ে ৩৪ শতাংশ। এই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন কিছু শিক্ষার্থীও রয়েছে যারা ভর্তি হওয়ার পর এক দিনের জন্যও অ্যাকাডেমিক কোনো কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেনি, এমনটাই জানিয়েছেন কলেজ শিক্ষকরা। ২০২২ সালের মার্চ মাসে ক্লাস শুরু হওয়া এই শিক্ষার্থীদের ১ বছর ৫ মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে ৩৪ ভাগের বেশি ঝরে যাওয়াকে অস্বাভাবিক বলে মনে করছেন স্থানীয় শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। স্থানীয় চাটখিল মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম মর্নিং পোস্ট'কে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার এই হার অন্য সময়ের চেয়ে বেশি। যা করোনার কারণে বেড়েছে বলেই মনে হচ্ছে। তবে এই সময়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করে তাদের শ্রেণি কার্যক্রমে ধরে রাখতে আমাদের শিক্ষকবৃন্দ শিক্ষার্থীদের প্রতি আগের চেয়ে বেশি যত্নশীল আচরণ করছেন।’ স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যে কোনো অ্যাকাডেমিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে করোনার বিষয়টি মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও তিনি জানান।
করোনা, মোবাইল আসক্তি, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের অসচেতনতাকে ঝরে পড়ার প্রধান কারণ বলে মনে করছেন চাটখিল উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. আহসান উল্যা চৌধুরী। পরিবারের পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার্থীদের সামাজিকীকরণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকবৃন্দ যে ভূমিকা রাখার কথা, করোনার কারণে সেখানে কিছুটা হলেও দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। ঠিক কী কারণে এত বেশি পরিমাণ শিক্ষার্থী ঝরে গেছে, এই বিষয় নিয়ে স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক অভিভাবক এবং ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বললে তারা বেশকিছু কারণ উল্লেখ করেন।সেগুলো হলো- অতিমারি করোনা: ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী করোনো অতিমারির যে দুর্যোগ নেমে এসেছিল তার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে শিক্ষার্থীদের ওপর। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার জন্য যে রকম মানসিক প্রস্তুতি থাকার কথা ঠিক সে রকম প্রস্তুতি তাদের ছিল না। দীর্ঘ মেয়াদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দূরে থাকার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত উপস্থিত থেকে শ্রেণি কার্যক্রমে নিয়োজিত রাখার যে মানসিকতা, সেটা থেকে অনেক শিক্ষার্থী সরে গেছে বলে মনে করছেন তারা। প্রবাসী : চাটখিল দেশের প্রবাসী অধ্যুষিত উপজেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। এখানকার ছেলেদের বেশিরভাগেরই লক্ষ্য থাকে পড়াশোনায় থাকাকালে একটি ভালো দেশের ভিসা পাওয়া। যে কারণে পড়াশোনা নিয়ে তাদের বেশিদূর এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকে না। এটিকেও ঝরে পড়ার আরও একটি কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
বিয়ে : নারী শিক্ষার্থীদের বিয়ের হার অন্য যে কোনো সময়ের চাইতে বেশি বলে মনে করছেন শিক্ষকবৃন্দ। তারা মনে করছেন- করোনা এবং করোনা পরবর্তী সময়ে পড়াশোনায় মনোযোগের ঘাটতি এবং সঠিক সময়ে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শেষ হওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা, এই দুটি কারণে বিয়ের হার কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। বিয়ের পর বেশিরভাগ নারী শিক্ষার্থীরাই আর অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন না। যে কারণে নারী শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ছে। আর্থিক সংকট ও উপবৃত্তি : বিগত কয়েক বছরে কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে বই-কাগজসহ শিক্ষা উপকরণের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। অভিভাবকদের অনেকে সন্তানদের সেই খরচ মিটাতে পারছেন না। বিপরীত ঘটনা ঘটেছে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রাপ্তিতে। কয়েক বছর আগেও শতকরা ৪০ ভাগ শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পেত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপবৃত্তি প্রাপ্ত সেসব শিক্ষার্থীকে কোনো বেতন দিতে হতো না। উপবৃত্তি কার্যক্রম পুরোপুরি অনলাইনে নেওয়ার পর এখন এই সংখ্যা আর নির্ধারিত নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো উপবৃত্তি পাওয়ার যোগ্য মনে করা শিক্ষার্থীদের ডেটা অনলাইনে সাবমিট করার পর যে পরিমাণ শিক্ষার্থী উপবৃত্তির জন্য চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হচ্ছেন, সে সংখ্যা আগের চেয়ে কম। এই শিক্ষাবর্ষে উপজেলার কলেজগুলোতে এই হার ২০ ভাগের একটু বেশি, মাদ্রাসাগুলোতে ১০ ভাগেরও কম এবং কারিগরিতে বলা যায় শূন্য। যে কারণে গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছেন। কেউ কেউ ঝরেও পড়ছেন।
মোবাইল/ইন্টারনেট আসক্তি : করোনাকালে অনলাইনে ক্লাস করার কারণে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর হাতেই মোবাইল দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে এই শিক্ষার্থীদের অনেকেই মোবাইল গেমস, ইন্টারনেট দুনিয়ায় আসক্ত হয়ে গেছে। যে কারণে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণে আগ্রহ কমে গেছে। তারা মোবাইল গেমস ও সোশ্যাল মিডিয়াতে যেভাবে সময় দিচ্ছেন, তার চাইতে অনেক কম সময় পড়াশোনায় দিচ্ছে। এর বাইরেও একটা ছোট সংখ্যা আছে যারা ভিন্ন ভিন্ন কারণে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ না করার কারণে অথবা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে খুব খারাপ ফল করায় ঝরে গেছেন কিংবা পূর্বের শ্রেণিতে থেকে গেছে। শিক্ষার্থীদের এমন ঝরে পড়াকে শিক্ষক ও অভিভাবকদের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও ভবিষ্যতের জন্য সমস্যা মনে করছেন। চাটখিল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ ইমরানুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘করোনার কারণে ঝরে পড়ার হার বেড়ে যাওয়া ছাড়াও এই উপজেলার অনেক শিক্ষার্থীই অ্যাকাডেমিক শিক্ষা অসমাপ্ত রেখে প্রবাসে চলে যায়। এটিও ঝরে পড়ার আরেকটি কারণ। অ্যাকাডেমিক একটি স্তরের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও সেটি শেষ না করা, কোনো বিশেষ দক্ষতা অর্জন না করে বিদেশে চলে যাওয়া। এটাকেও আমরা সমস্যা মনে করছি। কেননা অদক্ষতার কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব প্রবাসী বিভিন্ন দেশে কম পারিশ্রমিকে কাজ করতে বাধ্য হন। দক্ষতা অর্জন করে বিদেশে গেলে যা আরও বেশি ইতিবাচক হতে পারত। আর্থিক সংকটে ঝরে পড়ছেন, এমন শিক্ষার্থীর খোঁজ পাওয়া গেলে তাদের আমরা পূর্বেও সহযোগিতা করেছি এবং ভবিষ্যতেও করব।’ তিনি আরও বলেন, ‘নারীরাই আমাদের পরিবারের প্রাণ। নারীদের শিক্ষা প্রদান করা গেলে আগামী দিনের জন্য একটি শিক্ষিত পরিবার তৈরি হয়। আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নারীসহ ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা শূন্যের কোটায় নামানোর জন্য চেষ্টা করছি।’