শতর্দ্ধো প্রবীণ সুনিল মন্ডল। সাতক্ষীরা তালা উপজেলার মাগুরা ইউনিয়নের মাদরা গ্রামের স্বর্গীয় হরেন মন্ডলের ছেলে। উপজেলা জুড়ে ছোট বড় সকলের কাছে মাদুর দাদু হিসাবে পরিচিত। প্রায় ৭০ বছর ধরে পায়ে হেঁটে গ্রামে গ্রামে ফেরি করে মাদুর বিক্রয় করেন তিনি। প্রতিদিন সকালে কাঁধে মাদুর ঝুলিয়ে বাড়ী থেকে বের হন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি জন্য।কোন কোন দিন সব মাদুর বিক্রি হয়ে যায়,আবার কোন কোন দিন আল্প কিছু বিক্রি হয়।যে দিন মাদুর সব বিক্রি না হয়, সেদিন ৮-৯ কিঃমিঃ পথ পাড়ি দিয়ে উপশহর তালায় আসেন।আবার সন্ধ্যায় পায়ে হেঁটে বাড়ী ফিরে যান মাদুর দাদু।
সকালে তালা প্রেসক্লাবের পাশে চায়ের দোকানে ঢুকতেই চোখে পড়ল মাদুর কাঁধে দাঁড়িয়ে আছে সকলের প্রিয় মাদুর দাদু।দাদুকে দেখেই জিজ্ঞাসা করলাম, দাদু কেমন আছো ? উত্তরে,ভালো নেই,বলেই জিজ্ঞাসা করলো মাদুর নিবি দাদু? আমি না বলতেই,মলিন মুখে বলে উঠলো, দাদু আজ একটাও মাদুর বিক্রি হয়নি।একটু পরেই হাসি মুখে বললো,দাদু মাদুর না নিস এক কাপ চা খাওয়া। চায়ের অর্ডার দিয়ে দাদুকে পাশে বসালাম,চা খেতে খেতে দাদুর সাথে গল্প শুরু করলাম ।
গল্পের শুরুতেই বললেন, বাবা স্বর্গীয় হরেন মন্ডলের দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন তিনি।বাবার অবস্থা ভালো থাকায় তিনি সব সময় আনন্দ উল্লাসে মেতে থাকতেন।যুবক বয়সে তিনি যাত্রা পালায় অভিনয় করতেন।তবে কোন নায়ক বা ভিলেন নয়, তিনি মেয়ে সেজে নায়িকার পাঠ করতেন। কারন হিসাবে জানালেন,সে সময় অভিনয়ের জন্য মেয়ে পাওয়া যেতো না। তাই ছেলেরাই মেয়ে সেজে যাত্রাপালায় অভিনয় করতেন। বিয়ের পরেও তিনি যাত্রাপালায় অভিনয় করছেন। তবে বাবা অসুস্থ হলে তাকে ডেকে বললেন,দেখো সুনিল আমি আর কয়দিন বা বাঁচবো!এখন তোমার সংসার হয়েছে,কিছুদিন পর তুমি সন্তানের বাবা হবে।আমি যেটুকু পেরেছি তোমাদের জন্য করেছি।তুমি তোমার সন্তাদের জন্য কি করবে? বসে খেলে তো রাজার ভান্ডারেও কুলাবে না।এরপর চুপ করে কিছু সময় মাথা নিচু করে বসে থাকলেন।তারপর আবার বলা শুরু করলেন,বাবার সেই কথা আজও তার কানে বাজে।তখন থেকেই তিনি ব্যবসা শুরু করেন।প্রথমে দুধের ব্যবসা তার কয়েক বছর পরে মাদুরের ব্যবসা শুরু করেন।সেই থেকে এখন পর্যন্ত মাদুরের ব্যবসা করে যাচ্ছেন।আর যতদিন জীবন থাকবে ততদিন বাবার কথা স্মরণ করে ব্যবসা করবেন। তিনি অসুস্থ না হলে কখনো ঘরে শুয়ে বসে খাবেন না বলেও জানালেন দাদু সুনিল মন্ডল ।
এবার দাদুর কাছে বয়সের কথা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি আমার দিকে তাকিয়ে শুধু মাথা দুলাচ্ছেন।পাশ থেকে একজন বলে উঠলো দাদুর বয়স হয়েছে তাই কানে কম শোনে,একটু জোরে বলেন, না হলে কিছুই শুনতে পাবে না।এবার একটু জোরে জিজ্ঞাসা করতেই বলে উঠলে ১শ পাঁচ বছরের উপরে হবে, তার নিচে নয়।দুই ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানের জনক তিনি।মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে,বড় ছেলে শিক্ষাকতা করতেন,কিন্তু অসুস্থতার কারনে এখন বাড়ীতেই থাকেন।ছোট ছেলে ঘের ব্যবসা করেন।এখনো পরিবারের সবাই এক সঙ্গে বসবাস করছেন তবে তিনি মারা গেলে হযতো ছেলেরা আলাদা হয়ে যাবে এমনটাই ধারনা তার।
এই বৃদ্ধো বয়সেও মাদুরের ব্যবসা করছেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, জীবিকা নয় জীবনে সুস্থ ও ভাল থাকার জন্য ব্যবসা করি। ব্যবসা না করলেও চলে দাদু,শেখের বেটি আমারে বয়স্ক ভাতা দিয়ে জীবিকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এরপর বললেন,দাদু তোদের শরীরে এখন শুধু রোগ আর রোগ।আমার শরীরে কোন রোগ নেই।দাদু তোরা আমার বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকবি কিনা, আমি জানি না,আর যদিও বেঁচেও থাকিস তবে বিছানায়! আর আমি মানুষের ভালবাসায় প্রতিদিন সকালে মাদুর নিয়ে পায়ে হেঁটে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াবো।তোমার মত কত দাদু দিদি আমাকে ভালবাসে,তাদের ভালবাসায় আমি বেঁচে আছি।দাদু আজ আর বসবো না বলেই উঠে পড়লেন আর গলা ছেড়ে হাক দিলেন এই দাদু মাদুর নেবে মাদুর।