নওগাঁ জেলার বিভিন্ন আম বাগান ঘুরেও বিপুল আমের সমাহার দেখা গেছে। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে, দোল খাচ্ছে বিভিন্ন জাতের আম। বাগানে বাগানে চলছে শেষ সময়ের পরিচর্যা।

ধানের জন্য দেশের শস্যভান্ডার হিসেবে খ্যাতি আছে উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁর। বর্তমানে আমের রাজধানী হিসেবেও পরিচিতি পাচ্ছে এই জেলাটি। আম চাষ লাভজনক হওয়ায় জেলায় প্রতি বছরই সুস্বাদু এই ফলটির চাষাবাদ বাড়ছে।

চলতি মৌসুমে নওগাঁ জেলায় ২৯ হাজার ৪৭৫ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ৫০ টন। এই হিসাবে এবার জেলার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৪৩৫ টন আম।

প্রতি কেজি আমের গড় মূল্য ৫০ টাকা নির্ধারণ করে চলতি মৌসুমে ১ হাজার ৮৪২ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার আম বাণিজ্যের আশা করছে জেলার কৃষি বিভাগ।

এদিকে নওগাঁর আম পাড়ার সময়সীমাও নির্ধারণ করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। সে অনুযায়ী, আগামী ২৫ মে থেকে গুটি জাতের আম পাড়ার মধ্য দিয়ে এ জেলার আম পাড়া শুরু হবে। এ ছাড়া গোপালভোগ ৩০ মে, ক্ষীরসাপাত বা হিমসাগর ৫ জুন, নাগ ফজলি ৮ জুন, ল্যাংড়া ও হাঁড়িভাঙ্গা ১২ জুন, ফজলি ২২ জুন ও আম্রপালি আম ২৫ জুন থেকে পাড়া শুরু হবে। সর্বশেষ ১০ জুলাই থেকে পাড়া যাবে আশ্বিনা, বারী-৪ ও গৌরমতী জাতের আম।

জেলার বিভিন্ন আম বাগান ঘুরেও বিপুল আমের সমাহার দেখা গেছে। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে, দোল খাচ্ছে বিভিন্ন জাতের আম। বাগানে বাগানে চলছে শেষ সময়ের পরিচর্চা। কেউ ভিটামিন স্প্রে করছেন, কেউ পোকা দমনে কীটনাশক স্প্রে করছেন। মহামারি কেটে যাওয়ায় এবার ভালো বিক্রির আশায় বিভোর নওগাঁর আম চাষিরা।

জেলার পোরশা উপজেলার আম বাগান মালিক আব্দুল কুদ্দুস জানান, বিগত কয়েক বছরের চেয়ে এবার আম গাছগুলোতে বেশি মুকুল এসেছে। কিন্তু গাছে গুঁটি আসার সময় ও গুটি আসার পর তীব্র দাবদাহে পানিশূন্যতায় ব্যাপক হারে মুকুল ঝড়ে গেছে। এতে ফলন কিছু কম হবে। তবে বাজারে আমের ভালো দাম থাকলে তারা এবার লাভের আশাই করছেন।

সাপাহার উপজেলার রসুলপুর গ্রামের আম চাষি বাবুল হোসেন বলেন, ‘আমি তিন বিঘা জমিতে আম চাষ করেছি। গত বছর ফলন ভালো হলেও করোনা ও রোজার কারণে আমের দাম পাইনি। তবে এবার ফলন কম হলেও আমের ভালো দাম পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।একই উপজেলার মাহফুজুর রহমান ৩৫ বিঘা জমি বিভিন্ন মেয়াদে লিজ নিয়ে আম বাগান গড়ে তুলেছেন। তার বাগানে আম্রপালি, বারি-৪, গৌড়মতী ও আশ্বিনা জাতের সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি আমগাছ রয়েছে। এবার প্রতিটি গাছে যথেষ্ট পরিমাণ আমের মুকুল এসেছিল। কিন্তু তীব্র দাবদাহে গাছ থেকে ঝড়ে গেছে অসংখ্য মুকুল। এ ছাড়া কয়েক দফা ঝড়েও তার বাগানে আমের ক্ষতি হয়েছে। তারপরও গাছে যে পরিমাণ আম আছে, বাজারদর ভালো থাকলে লাভবান হওয়ারই আশা করছেন মাহফুজ।

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের তুলনায় জেলায় এবার আমের উৎপাদন বেড়েছে। গত মৌসুমে জেলায় আম উৎপাদন হয়েছিল ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৯৭৫ টন। গড়ে ৪৫ টাকা কেজি দরে আম কেনাবেচা নির্ধারণ করেছিল কৃষি অধিদপ্তর। সেই হিসাবে গত মৌসুমে ১ হাজার ৫৭০ কোটি ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকার আমের ব্যবসা হয়েছে।

চলতি মৌসুমে তুলনামূলকভাবে বেশি জমিতে আমের চাষ হয়েছে এবং আমের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৪৩৫ মেট্রিকটন। আর প্রতি কেজি আমের গড় মূল্য এবার ৫০ টাকা নির্ধারণ করায় ১ হাজার ৮৪২ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার আম বাণিজ্যের আশা কৃষি বিভাগের।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আরও জানায়, নওগাঁ জেলার ১১টি উপজেলায় কমবেশি আমের চাষ হয়। তবে সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদন হয় সাপাহার ও পোরশা উপজেলায়। চলতি মৌসুমে সাপাহারে ১০ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছে। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ধরা হয়েছে ১২.৬৫ মেট্রিক টন। পোরশা উপজেলায় ১০ হাজার ৫২০ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছে এবং এখানে হেক্টরপ্রতি ফলন ধরা হয়েছে ১২.৫০ মেট্রিক টন।

এ ছাড়া সদর উপজেলায় ৪৪৫ হেক্টর, রানীনগরে ১১০ হেক্টর, আত্রাইয়ে ১২০ হেক্টর, বদলগাছীতে ৫২৫ হেক্টর ও পত্নীতলায় ৪ হাজার ৮৬৫ হেক্টর, মহাদেবপুরে ৬৮০ হেক্টর, ধামইরহাটে ৬৭৫ হেক্টর, নিয়ামতপুরে ১ হাজার ১৩৫ হেক্টর এবং মান্দা উপজেলায় ৪০০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে।

জেলার সবচেয়ে বড় আমের আড়ত সাপাহার বাজারের আম ব্যবসায়ী কার্তিক দাস বলেন, ‘গত বছর করোনার কারণে ব্যবসায় খুব বেশি লাভ পাইনি। এবার হয়তো আমের ব্যবসায় গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারব।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. শামছুল ওয়াদুদ বলেন, ‘ইতোমধ্যে আম সংরক্ষণের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আগামী ২৫ মে থেকে গুটি জাতের আম পাড়ার মধ্য দিয়ে শুরু হবে আম পাড়া। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন জাতের আম পাড়া হবে। বেঁধে দেয়া তারিখের আগে কোনো চাষি আম নামালে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

এ ছাড়া ফরমালিনমুক্ত আম নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ টিম সব সময় মনিটর করবে বলেও জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এই উপপরিচালক।