পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের অমীমাংসিত বিষয় মোটাদাগে পাঁচটি।
* যুদ্ধাপরাধের দায় স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনা,
* ক্ষতিপূরণ প্রদান,
* সম্পদ বন্টন,
* বিহারীদের সমস্যা,
* ইতিহাস বিকৃতি ও কূটনৈতিক টানাপোড়েন।
# যুদ্ধাপরাধের দায় স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনা :
পাকিস্তান এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭১ সালের গণহত্যার দায় স্বীকার করেনি। বাংলাদেশ বারবার পাকিস্তানের কাছে আনুষ্ঠানিক দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা চাওয়ার দাবী করেছে কিন্তু পাকিস্তান কখনো স্পষ্টভাবে তা করেনি।
প্রসঙ্গত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী ১৯৭১ সালে গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্বিচারে হত্যা যুদ্ধাপরাধ/ মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।
# ক্ষতিপূরণ প্রদান :
মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি সেনাদের নৃশংসতা, অবকাঠামো ধ্বংস, গণহত্যা ও নারীদের ওপর নির্যাতনের জন্য বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণ দাবি করে আসছে। পাকিস্তান এখন পযর্ন্ত এই দাবি মানেনি এবং কোন প্রকার সমাধানের চেষ্টাও শুরু করেনি।
আন্তর্জাতিক আইনে ( Reparation Principal ) ভুক্তভোগী রাষ্ট্র ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য। উদাহরণ হিসেবে : ইরাক কুয়েত দখলের পর- ১৯৯১ সালে গালফ ওয়ার পরবর্তী জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে কুয়েত ইরাক থেকে ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলো।
# সম্পদ বন্টন :
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সময় পাকিস্তানে বাংলাদেশের প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদ (সোনা, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ, শিল্প - কারখানা, ব্যাংক আমানত, রেলওয়ে সম্পদ, জাহাজ ইত্যাদি ) আটকে ছিলো।
বতর্মানে যার বাজার মূল্য প্রায় (৩০-৩৫) বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
আন্তর্জাতিক আইনে নতুন রাষ্ট্র (Successor State) পুরোনো রাষ্ট্রের সম্পদের একটি অংশ পায়। এটি আন্তর্জাতিক 'রাষ্ট্র উত্তরাধিকার আইন' এর আওতায় পড়ে।
১৯৭৪ সালের ত্রিপাক্ষিক চুক্তি (Tripartite Agreement) অনুযায়ী 'পাকিস্তান' বাংলাদেশের সমস্ত প্রাপ্য সম্পদ ফেরত দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু আজও পযর্ন্ত পাকিস্তান তা ফেরত দেয়নি।
# বিহারীদের সমস্যা :
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সমর্থনকারী বহু উর্দুভাষী (বিহারী) বাংলাদেশ আটকে যায়। এদের অনেকেই যারা পাকিস্তানের নাগরিকত্ব দাবি করলেও পাকিস্তান তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করেনি ফলে তারা ফিরে যেতে পারেনি এবং বাংলাদেশে আটকে গেছে।
তারা পাকিস্তান সমর্থনকারী হিসেবে পাকিস্তানে চলে যেতে চেয়েছিলো। পাকিস্তান প্রথমে নিতে রাজি হলেও পরে আর নেয়নি। ফলে তাদের একটি অংশ আজও বাংলাদেশে বসবাস করছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশন (১৯৫৪, ১৯৬১) অনুযায়ী - যদি কোনো রাষ্ট্র তাদের নাগরিক হিসেবে নিতে অস্বীকার করে, তবে বসবাসরত রাষ্ট্রকে অভ্যন্তরীণভাবে সমাধান করতে হবে অর্থাৎ নাগরিকত্ব দিতে হবে।
* অভ্যন্তরীণ সমাধান মানে হলো—যেহেতু পাকিস্তান নিতে অস্বীকার করেছে, বাংলাদেশকেই তাদের নাগরিকত্ব প্রদান করে বাংলাদেশি হিসেবে একীভূত করতে হবে।
সেই হিসেবে - ২০০৮ সালে বাংলাদেশের হাইকোর্ট রায় দেয়, বিহারীদের মধ্যে যারা বাংলাদেশে জন্মেছে তারা বাংলাদেশি নাগরিক।
এরপর অনেকেই বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে ভোটাধিকার পেয়েছে তবে সমস্যা পুরোপুরি সমাধান হয়নি।
# ইতিহাস বিকৃতি ও কূটনৈতিক টানাপোড়েন :
পাকিস্তানের সরকারি পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি এবং বিভিন্ন মিডিয়া গুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করে তুলে ধরে। মুক্তিযুদ্ধকে একটি অভ্যন্তরীণ গন্ডগোল বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস গণহত্যা, অপকর্ম সব কিছুকে হালকা ভাবে দেখানোর চেষ্টা করে।
প্রসঙ্গত ৭১ এর গণহত্যাকে হালকা ভাবে দেখাতে গিয়ে ২০২০ সালে পাকিস্তানের একজন রাজনীতিক নেতা সাক্ষাৎকারে বলেন - "৭১ এর সংঘাত মূলত রাজনৈতিক সমস্যা, পাকিস্তানের সেনারা শুধু আইন শৃংখলা রক্ষা করেছিলো"
* পাকিস্তানের একটি বড় অংশ এখনো ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে স্বীকার করে না।
* পাকিস্তানের রাজনীতিক ও কিছু মিডিয়া বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামকে "ভারতের ষড়যন্ত্র" বলে তুলে ধরে। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ ও বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাস বিকৃত হয়।
* পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে জামায়াতে ইসলামীর অনেক নেতাকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে, যারা একাত্তরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামছ সহ বিভিন্ন নামে সংঘটিত হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে গণহত্যা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, বুদ্ধিজীবী হত্যার সহযোগী ছিলো এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় নানা রকম ভাবে দেশের ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত ছিলো।
এসব কর্মকাণ্ডের কারণে জামায়াত ইসলাম "মানবতাবিরোধী অপরাধী" দল হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত।
'জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ' স্বাধীনতার বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়।
তাদের নেতা গোলাম আযম, মওলানা কাদের মোল্লা, আলী আহসান মোজাহিদসহ অনেকে প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচার চালায়।
তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাপন্থী নেতাদের বিরুদ্ধে গিয়ে পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের সঙ্গে কাজ করেছে।
জামায়াত সরাসরি মুক্তিকামী মানুষ দমন করার জন্য অক্সিলিয়ারি ফোর্স তৈরি করে।
** রাজাকার বাহিনী –
মুক্তিকামীদের ধরতে, হত্যা করতে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করেছে।
** আল-বদর বাহিনী –
ছাত্র শিবিরের সদস্যরা মূলত এতে যুক্ত হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল কারিগর।
** আল-শামস বাহিনী –
মুক্তিকামীদের আতঙ্কিত করার কাজে নিয়োজিত ছিল।
*** ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আল-বদর বাহিনী (জামায়াত-শিবিরের সদস্যরা) পরিকল্পিতভাবে দেশকে মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ চালায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ অসংখ্যকে ধরে নিয়ে হত্যা করে।
*** জামায়াতের নেতারা পাকিস্তানি সেনাদের "ইসলামের রক্ষক" আখ্যা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের "ভারতের দোসর" বা "দেশদ্রোহী" হিসেবে প্রচার চালায়। পাশাপাশি ঐসময় বিভিন্ন ভাবে মসজিদ-মাদ্রাসায় পাকিস্তানের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে, সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালায়।
*** বাংলাদেশের দৃষ্টিতে যুদ্ধাপরাধী :
২০১৩ সালে কাদের মোল্লার ফাঁসির পর পাকিস্তান পার্লামেন্টে শোক প্রস্তাব নেয়া হয়।
বাংলাদেশের কাছে এটি ইতিহাস বিকৃতির পাশাপাশি শহীদদের প্রতি অবমাননা।
*** শিক্ষাক্ষেত্রে ও মিডিয়ায় ভিন্ন বয়ান প্রচার :
পাকিস্তানের স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে ১৯৭১ সালের ঘটনা "অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ" হিসেবে শেখানো হয়। বিভিন্ন মিডিয়াতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব ইতিহাস উপেক্ষা করে অবজ্ঞা ভরে প্রচার করা হয়।
পারস্পরিক আস্থার ঘাটতি, ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নে দ্বন্দ্ব, সীমিত সম্পর্ক। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে অবিশ্বাস ও শীতলতা বজায় আছে, যা বাণিজ্য, রাজনীতি ও আঞ্চলিক সহযোগিতায় প্রভাব ফেলছে।
*** ইতিহাস বিকৃতির কারণে বাংলাদেশ–পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্ক কখনো স্বাভাবিক হয়নি।
*** ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার দায় স্বীকার করেনি।
বারবার বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানানো হলেও পাকিস্তান তা এড়িয়ে গেছে।
বতর্মান সময়ে এসেও তাদের (পাকিস্তান রাষ্ট্রের) কথা-বার্তা, আচার-আচরণে কোন ধরনের অনুশোচনা বা দোষ স্বীকার করে নেয়ার মানসিকতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যার কারণে দু দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবার সম্ভাবনাও কম বলে মনে করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি ও দেশের আপামর জনগণ।