এতে কক্সবাজার পৌর এলাকাসহ কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত বাসিন্দারা চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে সর্তকতাও নির্দেশনা দিয়েছেন। বিগত সময় গুলোতে অবহেলার কারণে কক্সবাজার জেলায় পাহাড় ধসের ঘটনায় প্রাণনহানীর ঘটনা ঘটেছে। এমন সময়ে এলাকার সচেতন বাসিন্দারা তাদেরকে সচেতন করলে করলে বড় ধরনের দূর্ঘটনা থেকে রেহাই পাবে। এমন দৃশ্য কক্সবাজারের বাইরে রয়েছে, কাটা পাহাড়ের গায়ে তৈরি অবৈধ বাসস্থানে বসবাসকারী মানুষের জন্য আতঙ্কের সময় বর্ষাকাল। বর্ষণ শুরু হলেই চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার ও বান্দরবানের মতো পাহাড় এলাকায় নেমে আসে মৃত্যুবিভীষিকা। প্রবল বর্ষণে প্রায়ই ঘটে পাহাড়ধসের ঘটনা। আর পাহাড়ধসে মাটিচাপা পড়ে ঘটে মানুষের করুণ মৃত্যু। ২০১৭ সালে প্রবল বর্ষণের ফলে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানসহ চট্টগ্রামে মর্মান্তিক পাহাড়ধসে প্রাণ হারায় অন্তত ১৬৯ জন মানুষ। উদ্ধার কাজ চালাতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন ৫ সেনাসদস্য। বিধ্বস্ত হয় ১ হাজার ২০০ বাড়িঘর, ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাস্তাঘাট। ২০১৫ সালে পাহাড়ের মাটি ধসে পড়ে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও রামুতে নারী ও শিশুসহ ৩০ জন মৃত্যুবরণ করে। ২০০৭ সালের ভারি বর্ষণে চট্টগ্রামের হাটহাজারী, পাহাড়তলী, বায়োজিদ বোস্তামী, খুলশী এলাকায় পাহাড়ের মাটি চাপায় ১২৭ জন মানুষ নিহত হয়। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং এর পার্শ¦বর্তী এলাকায় পাহাড়ধসে ২০১৯ সালে ৭, ২০১৮ সালে ১১, ২০১২ সালে ২৮, ২০১১ সালে ১৭, ২০০৮ সালে ১৪ জন মৃত্যুবরণ করে। গত চার দশকে পাহাড়ধসে প্রাণহানি ঘটেছে ৬ শতাধিক মানুষের। এবারে আষাঢ়ের আগেই বর্ষার শুরুতে শুধু রাঙ্গামাটির প্রায় ২০ হাজার পরিবার পাহাড়ধসের আতঙ্কে দিন পার করছে।
চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের প্রতীক পাহাড় আজ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। পাহাড় কাটার ফলে জীববৈচিত্র্য হচ্ছে হুমকির সম্মুখীন, বন্যপ্রাণী হারাচ্ছে আবাসস্থল। প্রকৃতি হয়ে পড়ছে ভারসাম্যহীন। বিগত কয়েক যুগ ধরে পাহাড় কাটার পাশাপাশি পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজিকে নির্বিচারে ধ্বংস করে সমতলভ‚মিতে মুনাফালোভী সিন্ডিকেট গড়ে তোলে আবাসিক প্লট ও অভিজাত ফ্ল্যাট। নিম্নআয়ের হতদরিদ্র, ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীর জন্য পাহাড়ের গায়ে গড়ে ওঠে বস্তি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার পরিবারকে টাকার বিনিময়ে সেখানে ঠাঁই দেয়া হয়। দীর্ঘকাল ধরে পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ের গায়ে বেড়ে ওঠা গাছপালা উজাড়ের ফলে পাহাড়ের অবশিষ্ট মাটি আগলা হয়ে যায়। বৃষ্টি হলে পাহাড়ের গা বেয়ে তীব্র বেগে নেমে আসা ঢল আগলা মাটি ধুয়ে নিয়ে নিচে নামার ফলে পাহাড় হয়ে পড়ে দুর্বল, জীর্ণশীর্ণ। পাহাড় কাটার ফলে ভ‚মিধস ছাড়াও মাটির অণুজীব বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধীরে ধীরে হারাতে থাকে প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য। দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত পাহাড়ের মালিকানা ভ‚মি মন্ত্রণালয়ের। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় বনজসম্পদ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত। পাহাড় এলাকায় বাড়িঘর নির্মাণের নিয়ন্ত্রণ পূর্ত মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত। এদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা সুযোগ করে দিয়েছে নির্বিচারে পাহাড় কাটা, পাহাড়ের গায়ে দালানকোঠা, বস্তি নির্মাণের ক্ষেত্র। জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে মধ্য জুলাই পর্যন্ত পাহাড়ে ভ‚মিধসের আশঙ্কা থাকে। বর্ষাকালে পাহাড়ধস শুরু হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান থেকে বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়েও নেয়া হয়। এরপরেও কিছুসংখ্যক মানুষ জোর করে পাহাড়ে থেকে যায়। তাদের জন্য স্থায়ী কোনো আবাসস্থল না থাকায় কিছুদিন যেতে না যেতেই তারা পাহাড়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। কখনো তাদের বস্তি থেকে অমানবিকভাবে উচ্ছেদও করা হয়। তারপরও পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি বন্ধ হয় না। পাহাড়ের গায়ে গড়ে ওঠা বস্তি উচ্ছেদ পাহাড়ধসে মৃত্যুরোধের কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। প্রবল বর্ষণে পাহাড়ধসের সম্ভাবনা দেখা দিলে পাহাড়ে বসবাসকারীদের নিরাপদে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হতে পারে মানুষের মৃত্যু কমিয়ে আনার একটি সাময়িক ব্যবস্থা। কিন্তু তাতে কাটা পাহাড়ের ঢালে মানুষের বসবাস বন্ধ হবে না। রোধ করা যাবে না পাহাড়ধসে মৃত্যু। পাহাড়ের গায়ে অবৈধ বস্তি নির্মাণ করে অর্থ উপার্জন করা এবং পাহাড়ে বাসকারী আশ্রয়হীন মানুষকে মৃত্যুঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া বন্ধ করতে হবে। প্রভাবশালী মহলের পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে নিতে হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। পাহাড়ধসে মৃত্যু রোধ করতে হলে ন্যাড়া পাহাড়ে গাছপালা লাগিয়ে সবুজ আচ্ছাদনে ছেয়ে দিতে হবে। পাহাড়ে বসতি স্থাপন সম্পূর্ণ বন্ধ করতে স্থানীয় প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনকে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নিতে হবে। পাহাড় কাটা, পাহাড় কেটে অবৈধ বাড়িঘর নির্মাণ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধি ১৯৯৫-এর ১৫ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ২০০৭ সালের মর্মান্তিক পাহাড়ধসের ঘটনার পর গঠিত কমিটি পাহাড়ধসের ২৮টি কারণ নির্ধারণসহ ৩৬ দফা সুপারিশ প্রণয়ন করে, যা আজো বাস্তবায়িত হয়নি। প্রয়োজনে আলাদা সেল গঠন করে এসব সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়িত করতে হবে। ঠিক একইভাবে কক্সবাজারেও নানা পরিকল্পনা হলেও বাস্তবতায়ন হয় না।