কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার চুনিয়াপাড়া গ্রামের কৃষক রবিউল ইসলাম। তামাক চাষ করছেন গত ২৫ বছর ধরে

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার চুনিয়াপাড়া গ্রামের কৃষক রবিউল ইসলাম। তামাক চাষ করছেন গত ২৫ বছর ধরে। কারখানায় ফসল বিক্রি করে তাঁর সংসার চলে। গত বছর এক হেক্টরের জমিতে তামাক চাষ করেন। আয় হয় প্রায় সাত লাখ টাকার মতো। এ বছর একই পরিমাণ জমিতে তামাক চাষ করে খানিকটা বেশি দাম পাওয়ার আশায় ছিলেন। কিন্তু তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কারখানায় বন্ধ। বাড়িতে তামাক পাতার পড়ে আছ। হাতে নেই টাকা। এ অবস্থায় বড় ধরনের দুশ্চিন্তা-অনিশ্চয়তা ভর করেছে তাঁর সংসারে। 
নিজের ও তাঁর মতো অন্য তামাক চাষীদের কথা জানিয়ে রবিউল বলেন, ‘এখনও ফসল বিক্রি করতে না পারায়, পরিবারের ওপর প্রভাব পড়তেছে। এই ফসল দিয়াই আমরা সংসার চালাই, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাই, একটু স্বাচ্ছন্দ্যে চলি। কিন্তু এবার যদি তামাক না বেচতে পারি বড় বিপদে পইড়া যাব? শুধু আমি না, আমার মত আরও যেসব চাষি আছে, সবাই দুশ্চিন্তায় দিন কাটাইতেছে।’
একই উপজেলার নওদা গোপালপুর গ্রামের রাহুল সর্দার বলেন, ‘তামাক আমার দাদায় আবাদ করসে, আমার বাবা আবাদ করসে, এখন আমুও করছি। অন্য ফসলও আবাদ করি। যেমন ধান। ধান তো তিন-সাড়ে তিন মাসের ফসল। তবে বেশি নির্ভর করি তামাকের ওপরে। এই বছরও গত বছরের মতোই ১২ বিঘা জমিতে তামাক করছি। প্রায় ৬ লক্ষ টাকার তামাক এখনও আমার বাসায়ই পড়ে আছে।’
তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের কারণে কোম্পানি ঠিকমতো দাঁড়াইতে পারতেছে না, তামাকও কিনতে পারতেছে না। কোম্পানি বাদে তো আমাদের তামাক নিয়ার লোক নাই। তামাক যদি এখন বিক্রিই করতে না পারি, তাহলে তো ঘরে পড়ে থাকা তামাকটা একসময় ফেলায় দেয়া লাগবে মনে হচ্ছে। ক্যামনে? বেচতে না পাড়লে ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া চলবে ক্যামনে? দেয়ালে পিঠ ঠেইকা যাবে। কিছু লোকের কারণে কারখানা বন্ধ হয়ে আছে। এইসব লোকদের কারণে আমরা চাষি মহল ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছি।’
কুষ্টিয়ায় বিএটি বাংলাদেশের তামাক প্রক্রিয়াজাত কারখানা গ্রিন লিফ থ্রেশিং প্ল্যান্ট (জিএলটি) তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকায় রবিউল ইসলাম ও রাহুল সর্দারের মত জীবন-জীবিকার এমন অনিশ্চয়তায় পড়েছে হাজার হাজার কৃষক। গত ২৩ এপ্রিল অনাকাঙ্ক্ষিত শ্রমিক অসন্তোষের জেরে বন্ধ হয়ে যায় কারখানাটি। শ্রমিকদের একাংশের অনীহার কারণে সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব না হওয়ায়, কারখানাটির উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রয়েছে। ফলে তামাক বিক্রি করতে পারছেন না স্থানীয় কৃষকরা। ঘরে পড়ে আছে লাখ লাখ টাকার শুকনো তামাকপাতা। আর চাষির ঘরে জমছে দুশ্চিন্তা, ক্ষুধা আর অনিশ্চয়তা।
মৌসুমি শ্রমিকদের আন্দোলনের কারণে টানা তিন সপ্তাহ ধরে বন্ধ রয়েছে তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণের এ কারখানা। বিষয়টি ঘিরে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে কৃষি, রপ্তানি ও বিনিয়োগে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, অচলাবস্থার কারণে ক্ষতির মুখে পড়তে পারে অর্থনীতি। 
মৌসুমি শ্রমিকদের অবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে এ সঙ্কটের শুরু হয়। তামাক মৌসুম শুরুর প্রাক্কালে আন্দোলনের ফলে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায় কারখানার কার্যক্রম। এ পরিস্থিতির কারণে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ৫০ হাজারেরও বেশি কৃষক। বিক্রি ও কারখানায় প্রক্রিয়াজাত না হলে, বিপুল পরিমাণ তামাকপাতা নষ্ট হয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। যার প্রভাব পড়বে অন্যতম প্রধান এই কৃষিপণ্যের রপ্তানিতেও।
কুষ্টিয়া অঞ্চলের কৃষকদের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল তামাক। বছরজুড়ে হালচাষ, চারা রোপণ, আগাছা দমন, সেচ, শুকানোর পর এই ফসল বাজারে তুলে দেন তাঁরা। আশাই থাকেন- কোম্পানি কিনবে, ভালো দাম পাবেন, সংসার চলবে। কিন্তু এবার সে চাকা যেন হঠাৎ থেমে গেছে।
এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতি এর আগে কখনও দেখেননি প্রায় ২৫ বছর ধরে তামাক চাষ করে আসা মিরপুর উপজেলার আহমেদপুর গ্রামের চাষি আব্দুল মানান। তাঁর মতে, এতো টাকা খরচ করে এখন তামাক বিক্রি করতে না পারলে, তার মতো সব চাষিই বড় ধরনের আর্থিক সংকটের ভিতর পড়ে যাবে। কৃষকরা একটি ফসল বিক্রি করে আরেকটা চাষ করেন, এভাবেই চলে। এ বছর যদি ফসল বিক্রি না হয় তাহলেও পরের বছরের চাষ পরিকল্পনাতেও তার প্রভাব পড়বে। আগামী বছর অনেকেই হয়ত তামাক চাষ বাদ দিবে বা কম করে চাষ করবে।
প্রায়ই একই ধরনের আশঙ্কার কথা জানান চুনিয়াপাড়া গ্রামের কৃষক জিন্নাহ আলী। তিনি বলেন, ‘তামাক ছাড়াও চাষিরা বিভিন্ন ফসল করে। একটা ফসলের ওপর আরেকটা ফসল নির্ভর করে। যেমন, তামাক বিক্রি কইরা যে টাকা আসবে, সেই টাকা দিয়াই আবার পরের ফসল করা হয়। এই বছর যদি কোনো চাষি কোনো ফসলে লোকসান হয় বা বিক্রি না হয়, তাহলে পরের বছর সেই ফসল আবার তৈরি করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।’
তিনি বলেন, ‘এখন কারখানাটা যদি বন্ধই থাকে, আর সেই সমস্যার সমাধান না হয়, তাহলে চাষিদের সামনে একটা বড় সমস্যা অপেক্ষা করতেছে। চাষিরা তো শুধু তামাক করে না, ধান করে, শাকসবজি করে, কেউ কেউ ভুট্টা করে – এইসব মিলায়ে চাষির জীবন চলে। কিন্তু একটা ফসল বিক্রি না হইলে, সব হিসাব গুবলেট হইয়া যায়। সংসার চালানো মুশকিল হয়ে পড়ে। ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া, চিকিৎসা, সংসারের খরচ – সব কিছুতেই টান পড়ে। এই অবস্থায় চাষি যেমন কষ্টে পড়ে, তেমনি তার পরিবারও বিপদে পড়ে।’ 
জীবন-জীবিকার এমন সংকট কাটিয়ে ওঠতে দ্রুত এই অচলাবস্থার সমাধান চান স্থানীয় কৃষকরা। তাঁরা চান একটি শান্তিপূর্ণ, কার্যকর সমাধান। গোবিন্দপুর গ্রামের কৃষক জিয়াউর রহমান বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে আমাদের প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচ পড়ে। এখন যদি এই তামাক আমরা বিক্রি করতে না পারি, তাহলে তো আমাগো বিশাল লস হইয়া যাইবো। এইভাবে চললে তো চাষি হিসেবে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবো। আর চাষিরা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হই, তাহলে আমাদের তো রাস্তায় নামতে হবে। আমরা চাই যে, সরকার এবং যারা পেছন থেকে কারখানা বন্ধের জন্য দায়ী তাদের বের করে যাতে সঠিক সমাধান করা হয়।’ 
কৃষক রবিউল ইসলাম বলেন, ’এই যে কারখানা নাকি বন্ধ কইরা রাখছে কিছু লোক, এই কারণে শুধু আমি না, আমার মত অনেক চাষিই বিপাকে পড়ছে। এই সমস্যার দ্রুত একটা সুরাহা দরকার। সমাধান যদি তাড়াতাড়ি না হয়, তাহলে তো আমরা আরও বিপাকে পড়বো। আমরা চাষিরাই তো মরবো শেষমেশ!’