আগামী বছরই বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ চাপ আসছে। এ বছরই সবচেয়ে বেশি প্রায় দেড় হাজার কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধ করতে হবে ১২৭০ কোটি ডলার। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ শোধ করতে হবে ২১৫ কোটি ডলার। দুই খাতের ঋণ পরিশোধে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়বে। এখন নতুন ঋণ নেওয়া কমিয়ে দিলে এরপর থেকে পরিশোধের চাপ কমে যাবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, মোট বৈদেশিক ঋণ ৯৫০০ কোটি ডলার। যা মোট জিডিপির ২২ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি খাতে ৬৭৮৯ কোটি ডলার। বেসরকারি খাতে ২৭০০ কোটি ডলার। সরকারি খাতের বেশির ভাগ ঋণই দীর্ঘমেয়াদি। যে কারণে ঝুঁকি কম। বেসরকারি খাতে ঋণের বেশির ভাগই স্বল্পমেয়াদি। যে কারণে ঝুঁকি বেশি। বর্তমানে স্বল্পমেয়াদি ঋণ রয়েছে ১৬০০ কোটি ডলার। যা আগামী বছরের মধ্যে পরিশোধের কথা রয়েছে। এর মধ্যে কিছু ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। ফলে আগামী বছরে স্বল্পমেয়াদি ঋণের মধ্যে ১ হাজার ২৭০ কোটি ডলার পরিশোধ করে বাকি ঋণের মেয়াদ বাড়ানো যাবে। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৯ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে চলতি বছরে বেসরকারি খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ১৪৪ কোটি দিতে হবে। এতে মূল ঋণ ১২৫ কোটি ও সুদ ১৯ কোটি ডলার। আগামী বছর তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাবে। পরিশোধ করতে হবে ২১৪ কোটি ডলার। এর মধ্যে মূল ঋণ ১৯৫ কোটি ডলার ও সুদ ২০ কোটি ডলার।

২০২৪ সাল থেকে এই চাপ অর্ধেকের বেশি কমে যাবে। কেননা স্বল্পমেয়াদি ঋণ নতুন করে নেওয়া কমিয়ে দিলে তা ৪০০ কোটি ডলারে নেমে আসবে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধও অর্ধেকের বেশি কমে যাবে। অর্থাৎ ২০২৪ সালে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধ করতে হবে মাত্র ৯০ কোটি ডলার। এভাবে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত সামান্য হারে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ২০৩৪ থেকে ২০৩৮ সালের মধ্যে আরও কমে যাবে। ২০৩৯ সালে সাড়ে ৩ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। তবে নতুন স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিলে চাপ বাড়বে।

এক বছরের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণের ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার শোধ করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ১ থেকে ৩ বছরের মধ্যে ১৮০ কোটি ডলার, ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে ৪৩ কোটি ডলার, ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে ৬১ কোটি ডলার, ৭ থেকে ১০ বছরের মধ্যে ৫২ কোটি ডলার, ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে ৬১ কোটি ডলার, ১২ বছরের বেশি ৩৭৬ কোটি ডলার। বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণের মধ্যে গত আড়াই বছরে চীন থেকেই বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। বেড়েছে প্রায় ৫ গুণ। এরপরই রয়েছে ভারত ও হংকংয়ের স্থান। গড়ে বৃদ্ধির হার প্রায় ১৫ শতাংশ। এসব দেশ থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদি ঋণও নেওয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও জাপান থেকে বেড়েছে ৫ শতাংশের মতো। তবে যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব-আমিরাত থেকে ঋণ কমেছে।

প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, চীন থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরের পর্যন্ত ঋণের স্থিতি ছিল ৫০ কোটি ডলার। গত জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫০ কোটি ডলার। এর মধ্যে ১৭৫ কোটি ডলার দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। যেগুলো ১ বছরের বেশি থেকে ১২ বছরের বেশি মেয়াদে পরিশোধ করতে হবে। এসব ঋণে তেমন ঝুঁকি নেই। কিন্তু স্বল্পমেয়াদি ঋণ হচ্ছে ৭৫ কোটি ডলার। যা আগামী বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। ইতোমধ্যে কিছু ঋণের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। আরও বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। চীন থেকে গত অর্থবছরে ৭ হাজার ৫৬০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ পণ্য আমদানি হয়েছে বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায়। ইতোমধ্যে বেশ কিছু অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে।

২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত হংকং থেকে নেওয়া ঋণের স্থিতি ছিল ১৪০ কোটি ডলার। এখন তা বেড়ে ১৬২ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। ওই সময়ে ঋণ বেড়েছে ১৫ শতাংশ। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ১৩৮ কোটি ডলার ও ২৪ কোটি ডলার স্বল্পমেয়াদি। এসব ঋণ আগামী বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। বিভিন্ন পণ্য আমদানির বিপরীতে ঋণগুলো নেওয়া হয়েছে। ভারত থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ খুবই কম, স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি। পণ্য আমদানির আওতায় এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে। গত অর্থবছরে ভারত থেকে ১৩৭০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এর প্রায় ১৫ শতাংশ এসেছে বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায়। তবে এর বড় অংশই পরিশোধ হয়ে গেছে। ১০৮ কোটি ডলার বকেয়া রয়েছে। যেগুলো আগামী বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে কিছু ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।

যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও জাপান থেকে বেশির ভাগই নেওয়া হয়েছে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাজ্য থেকে নেওয়া ঋণের স্থিতি ছিল ৭৬ কোটি ডলার। তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৩ কোটি ডলারে। একই সময়ে জার্মানি থেকে নেওয়া ঋণের স্থিতি ২৫ কোটি থেকে বেড়ে ৩৭ কোটি ডলার হয়েছে। জাপান থেকে নেওয়া ঋণ ১৩ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ১৮ কোটি ডলার। অন্যান্য দেশ থেকে নেওয়া ঋণ ৮৩৭ কোটি থেকে বেড়ে ৬ হাজার ১৭৯ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। আলোচ্য সময়ে সার্বিকভাবে দেশের বৈদেশিক ঋণ যেখানে বেড়েছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব-আমিরাত থেকে ঋণ কমেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঋণ ৮৯ কোটি থেকে কমে ৮০ কোটি ডলার, নেদারল্যান্ডস ৬৩ কোটি থেকে কমে ৫৩ কোটি ডলার, সিঙ্গাপুর থেকে ৪২ কোটি থেকে কমে ৪১ কোটি ডলার, সৌদি আরব থেকে ৩০ কোটি থেকে কমে ২১ কোটি ডলার, সংযুক্ত আর আমিরাত থেকে ১৩ কোটি থেকে কমে ১০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় আমদানি হয়েছিল ১ হাজার ৬৩৩ কোটি ডলারের পণ্য। গত অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ২ হাজার ৩৩২ কোটি ডলারের পণ্য। আলোচ্য সময়ে এ খাতে ঋণ বেড়েছে ৬৯৮ কোটি ডলার বা ৪৩ শতাংশ।জ্বালানি তেল আমদানিতে ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ট্রেড অ্যান্ড ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি) থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণের স্থিতি গত ৩০ জুন দাঁড়িয়েছে ৯২ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ে তা ছিল ৭৩ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে ঋণ বেড়েছে ১৮ কোটি ডলার বা ২৫ শতাংশ।

নগদ ও বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় গত অর্থবছরে সিঙ্গাপুর থেকে ৪১২ কোটি ডলার, মালয়েশিয়া থেকে ৩৪৭ কোটি ডলার, ইন্দোনেশিয়া থেকে ৩০৮ কোটি ডলার, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৮৩ কোটি ডলার, জাপান থেকে ২৪৪ কোটি ডলার, ব্রাজিল থেকে ২২৫ কোটি ডলার, কাতার থেকে ২১৮ কোটি ডলার, সৌদি আরব থেকে ১৭০ কোটি ডলার, সংযুক্ত আরব-আমিরাত থেকে ১৬৫ কোটি ডলার, কোরিয়া থেকে ১৫০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া থেকে ১২৪ কোটি ডলার, তাইওয়ান থেকে ১১০ কোটি ডলার, থাইল্যান্ড থেকে ১০৫ কোটি ডলার, ভিয়েতনাম থেকে ১০১ কোটি ডলার, জার্মানি থেকে ৯৬ কোটি ডলারের পণ্য এসেছে।