গত ১৪ জানুয়ারি (মঙ্গলবার ) প্রাচীনতম ঐতিহাসিক শুক্লাম্বর দীঘির স্নান উৎসব। উপজেলার বরমার সনাতন সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান শ্রী শ্রী শুক্লাম্বর দীঘি ও তৎসংলগ্ন প্রায় ১০ থেকে ১২ একর বিশাল এলাকা ও ২ থেকে ৩ কিলোমিটার সড়ক জুড়ে এ মেলা বসে। মেলা একদিন হলেও আগের দিন বিকেল হতে পূণ্যার্থী, তীর্থযাত্রী, দোকানী ও পূজারীদের আগমন ঘটে। সকালে দেখা যায়, মেলাঙ্গনে উপচেপড়া মানুষের ভীড় জমে।প্রতিবছরের মতো এবারও ৩০ পৌষ চন্দনাইশের শুক্লাম্বর দিঘির মেলায় ঢল নেমেছিল মানুষের। ১৪ জানুয়ারি ভোর সকাল থেকে দিঘিরপাড় মুখরিত হয়ে উঠেছিল পুণ্যার্থীদের পদচারণায়। আত্মশুদ্ধি, পাপমুক্তি ও মনোবাসনা পূরণের জন্য দূর-দূরান্ত থেকে এবার পুণ্যার্থীরা এখানে এসেছেন। মনোবাসনা পূরণের জন্য মেলায় আসা পুণ্যার্থীদের অনেকে অশ্বত্থ গাছের নিচে কবুতর উড়িয়ে দেন। আবার কেউ কেউ দিঘিতে তীব্র শীত উপেক্ষা করে স্নান করেন। অনেকে দিঘির জলে ঢেলেছেন তরল দুধ। মনের ইচ্ছে পূরণের জন্য অশ্বত্থ গাছের ডালে সুতা বাঁধছিলেন মেলায় আগত নবদম্পতি শ্রাবন্তী ধর ও তাঁর স্বামী ও বিকাশ ধর। অনেকের কাছে এই মেলার কথা অনেক শুনেছেন, এবার আসতে পেরে ভীষণ খুশি বলে জানালেন তাঁরা। আমাদের পার্শ্ববর্তী হারলা গ্রাম থেকে থেকে জুয়েল কুমার শীল মেলায় এসেছেন তিনি জানান, এই মেলায় এলে মনোবাসনা পূরণ হয়।
কনকনে শীত উপেক্ষা করে পাপমুক্ত নতুন জীবন লাভের আশায় দিঘির জলে স্নান করতে নেমেছিলেন নানা বয়সের নারী-পুরুষ। সনাতন বা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠান হলেও মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদেরও সমাবেশ ঘটে। তাদেরও সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়। বিশেষ করে নারীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যনীয়। মেলায় নাগরদোলাসহ বিভিন্ন ধরনের বেতের তৈরি টুকরি, বড় ঝুড়ি, চালুনি, কুলা, মোড়া, দা-বটি-ছোরা, যাঁতা, মাটির ঘটি-বাটি, শীতের সবজি, মানকচু, শাপলা মাছ, ইলিশ, দেশি পুকুরের মাছ, চটপটি, বিনি ধানের খই, যব ধানের খই, বাতাসা, গস্যার টফি, বাদামের টফি, নিমকি বিস্কুট, নকুল দানা, কদমা, গজা, নারকেলের চিড়া, রংবেরংয়ের ঘুড়ি নিয়ে মেলায় এসেছেন দূর-দূরান্তের বিক্রেতারা। প্রতি বছরের মত এবারও পৌষ সংক্রান্তির মেলায় পার্শ্ববতী ভারতসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বিভিন্ন মানত নিয়ে এ পীঠমন্দিরে আসে। মেলায় যারা বিভিন্ন মনোবাসনা নিয়ে আসেন তা পূর্ণ হয় বলে তাদের বিশ্বাস। তাছাড়া সারা বছর প্রতিদিন বিভিন্ন মানস নিয়ে পূর্ণের লক্ষ্যে দীঘিতে দুধ উৎসর্গ, ছাগল ও কবুতর, ফল-ফলাদি ইত্যাদি দেয় বলে জানা যায়। তাদের বিশ্বাস, এখানে দুধ, ছাগল, কবুতর এমনকি সোনার অলংকার উৎসর্গ করলে মনের সব বাসনা পূরণ হয়। আর তাই সারা বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষের নানা ধরণের মনোবাসনা পূরণের লক্ষ্যে মানুষগুলো একই মহনায় মিলিত হওয়ায় শুক্লাম্বর দীঘি হয়ে উঠে থাকে প্রতি বছর মিলন মেলায়। এখানে দিনব্যাপী চলে উৎসব। সে সাথে প্রত্যেকে স্ব-স্ব ধ্যানে-জ্ঞানে মগ্ন থাকেন পূজা অর্চনায়। পূর্ণার্থীদের ভিড়ে এ দিনটি উৎসবমূখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এশিয়ার হিন্দুদের জন্য অন্যতম তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত শুক্লাম্বর পীঠমন্দির। শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য্য ভারতের নবদ্বীপ নদীয়া থেকে চন্দনাইশের বরমার বাইনজুরীতে আগমন করেছিলেন। তিনি ১১ একর জায়গায় শিবমন্দির সৃষ্টির মাধ্যমে সাধনা শুরু করেছিলেন। বছরের পর বছর ধর্মীয় সাধনার মাধ্যমে সিদ্ধি লাভ করেন। তার অলৌকিকতায় শঙ্খনদী বরমা এলাকার দিকে প্রবাহিত হতে থাকলে তার মহান সাধনায় শঙ্খনদীর গতি ফিরে যায় বলে তাদের বিশ্বাস। তৎকালীন সময়ে এলাকায় নারী-পুরুষের বিবাহ অনুষ্ঠানের যাবতীয় সরঞ্জামাদি স্বর্ণ, রৌপ্য, হীরা ও মূল্যবান ধাতুর তালিকা মহাসাধক শুক্লাম্বর এর হাতে দিলে বিবাহের দিন উক্ত দীঘিতে তালিকাভুক্ত সকল মালামাল ভেসে উঠত বলেও তারা জানান। শ্রী শ্রী শুক্লাম্বর দীঘি উন্নয়ন কমিটির সভাপতি হারাধন দেব ও সিনিয়র সহ-সভাপতি অরুপ রতন চক্রবর্তী জানান, দক্ষিণ এশিয়ায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য অন্যতম তীর্থস্থান এই শুক্লাম্বর দিঘির মেলা। শুক্লাম্বর ভট্টাচার্য ত্রিপাঠির নামেই এই মেলার নামকরণ। প্রায় ৪০০ বছর আগে ভারতের নদিয়া এলাকায় জন্ম হয় তাঁর। ৪০ বছর বয়সে সনাতন ধর্ম প্রচারের জন্য ভারত থেকে চন্দনাইশের বরমায় আসেন তিনি। বরমায় বেশ কিছু জমি কিনে শিবমন্দির তৈরির মাধ্যমে ধর্মপ্রচার ও জনসেবা শুরু করেন। তিনি আরও জানান, এই শুক্লাম্বর দিঘীর মেলায় সনাতন ধর্মের লোক ছাড়াও প্রতিবছর বিভিন্ন ধর্মের হাজার হাজার নারী পুরুষ মেলা দেখতে আসেন। মেলা উপলক্ষ্যে গতকাল দূর-দূরান্ত থেকে আসেন নানান বয়সের দেশি-বিদেশিসহ হাজার হাজার ভক্ত। শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই নয় মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষ আসেন এ মেলায় । মেলা চলাকালীন সময়ে চন্দনাইশ উপজেলা নিবার্হী অফিসার মো. রাজিব হোসেন, থানা অফিসার ইনচার্জ ইমরান আল হোসাইন দীঘির উন্নয়ন কমিটির সভাপতি হারাধন দেব, সিনিয়র সহ-সভাপতি অরুপ রতন, সাধারণ সম্পাদক নিপেন্দু দত্ত ,পরিমল দেবস দিঘি কমিটির সকল সদস্যবৃন্দ। মেলায় উপজেলা প্রশাসন ও চন্দনাইশ থানা পুলিশ এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।