এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহে ঘাটতি। সব মিলে শিল্প খাতের খরচ বেড়ে গেছে। এর প্রভাবে বেড়েছে পণ্যের দাম। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ভোক্তাদের মধ্যে বিরাজ করছে অনিশ্চয়তা। তাদের আয়ও কমে গেছে। ফলে বাধ্য হয়ে তারা ব্যয় কমানোর নীতি গ্রহণ করেছেন। এতে শিল্প পণ্যের বিক্রি কমে গেছে। বড় শঙ্কার মধ্যে পড়েছে রপ্তানি খাত। বাংলাদেশের প্রধান বাজার ইউরোপ ও আমেরিকায়। ওই দেশগুলোতেই মন্দা চলছে। এতে রপ্তানির আদেশ কমে গেছে। ফলে রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমেছে। গত ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে রপ্তানি আয়ও কমেছে। বর্তমানে শুধু রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের মালিকরা নিজস্ব আয়ের ডলার দিয়ে ‘ব্যাক টু ব্যাক’ এলসি খুলতে পারছেন। তারা পণ্য রপ্তানি করে সেই ডলার দিয়েই এলসি খুলছেন। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম ও দেশের ভেতরে ডলার, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সব খাতে খরচ বেড়েছে।
ওই হারে রপ্তানি পণ্যের দাম বাড়েনি। ফলে রপ্তানি আয় দিয়ে স্থানীয় খরচ মেটানোর পর যে ডলার থাকছে তা দিয়ে কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা যাচ্ছে না। আরও বাড়তি ডলার লাগছে। এগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে ঋণ হিসাবে নেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে যাদের ডলার আয় নেই, তারা এখন বলতে গেলে এলসি খুলতে পারছে না। যাদের ডলার আয় কম, কিন্তু এলসি খোলার পরিমাণ বেশি, তারাও এলসি খুলতে পারছেন না। ফলে একমাত্র রপ্তানি খাত ছাড়া বাকি সব খাতে ডলার সংকটের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত বছরের জুলাই থেকে শিল্পের কাঁচামালের আমদানির এলসি খোলা কমতে শুরু করেছে। কিন্তু আমদানি বাড়ছে আগের খোলা এলসির। এখন আমদানিও কমে গেছে। অনেক শিল্পের কাঁচামালের এলসি খোলার পাশাপাশি আমদানিও কমে গেছে। ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা রয়েছেন যারা পণ্য উৎপাদন করে দেশীয় বাজারে পণ্যের জোগান দেন।
এদের অনেকে আবার রপ্তানিমুখী শিল্পে পণ্যের জোগান দিয়ে প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারক হিসাবে কাজ করেন। তারা নিজেরা এলসি খোলেন না। কিন্তু তারা বাণিজ্যিক আমদানিকারকদের কাছ থেকে পণ্য কিনে উৎপাদন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। ডলার সংকটের কারণে বাণিজ্যিক আমদানিকারকরাও এখন এলসি খুলতে পারছেন না। ফলে বাণিজ্যিকভাবে ছোট শিল্পগুলোও কাঁচামাল সংকটে পড়েছে। গত অর্থবছরে এলসি খোলা বেড়েছিল ৩৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। আমদানি বেড়েছিল ৪৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। এর মধ্যে শিল্পের যন্ত্রপাতি এলসি খোলা বেড়েছিল ৩৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং আমদানি বেড়েছিল ৪৭ দশমিক ০৩ শতাংশ। শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা বেড়েছিল ২৮ দশমিক ২৯ শতাংশ এবং আমদানি বেড়েছিল ৩৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। ডলার সংকটের কারণে এখনকার পরিস্থিতি উলটো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে সার্বিকভাবে আমদানির এলসি খোলা কমেছে ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং আমদানি বেড়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৭১।
এর মধ্যে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি কমেছে ২৭ দশমিক ২৭ শতাংশ এবং আমদানি কমেছে ১২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। অর্থাৎ এলসি এবং আমদানি দুটোই কমেছে। এলসি খোলা কমায় আগামীতে আমদানিও কমে যাবে। তখন সংকট আরও ঘনীভূত হবে। শিল্প খাতের কিছু অর্ধেক তৈরি পণ্য আমদানি করে দেশে পূর্ণাঙ্গ পণ্য উৎপাদন করা হয়। এ ধরনের কাঁচামালকে বলা হয় মধ্যবর্তী কাঁচামাল। শিল্পের এ ধরনের কাঁচামালের এলসি কমেছে ৩৩ দশমিক ১৮ শতাংশ, আমদানি কমেছে ১৭ দশমিক ০২ শতাংশ। ফলে এ খাদের শিল্পেও কাঁচামালের সংকট প্রকট হয়েছে। এছাড়া নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য শিল্পের যন্ত্রপাতির এলসি কমেছে ৬৫ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং আমদানি কমেছে ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ। দুটোই কমায় নতুন শিল্প স্থাপন প্রক্রিয়ায়ও থেমে গেছে। এখন সীমিত আকারে কিছু যন্ত্রপাতি আসছে শুধু চালু শিল্প সচল রাখার জন্য। বিবিধ শিল্পের যন্ত্রপাতি এলসি কমেছে ৪১ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং আমদানি কমেছে ২১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। সূত্র জানায়, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে গত মার্চ থেকে ডলার সংকট দেখা দেয়। মে মাসে এটি প্রকট আকার ধারণ করে। তখন থেকেই এলসি খোলা নিয়ন্ত্রিত করা হয়। এখন নিজস্ব ডলার ছাড়া শিল্প খাতের কাঁচামালের এলসি খোলা যাচ্ছে না।
সংকটের পর থেকে গত জুলাই থেকে এলসি খোলা কমা শুরু হয়। ওই মাসে কমেছিল প্রায় ১০ শতাংশ। এরপর থেকে তা বাড়তে থাকে। জ্বালানির দাম বাড়ায় বিদ্যুৎ খাতে এর ব্যবহার কমেছে। সার্বিকভাবে পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানি বাড়লেও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি কমেছে। এ খাতে এলসি কমেছে ৪৪ দশমিক ০৩ শতাংশ এবং আমদানি কমেছে ৫৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। বিদ্যুতের উৎপাদন কম হওয়ায় শিল্প খাতে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিল্প সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাতের পণ্য আমদানিতে এলসি খোলা কমেছে ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ। তবে আমদানি বেড়েছে ১৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এর মধ্যে কমার্শিয়াল খাতের পণ্য আমদানি এলসি কমেছে ২২ দশমিক ২৮ শতাংশ। তবে এ খাতে আমদানি বেড়েছে ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ‘ব্যাক টু ব্যাক’ এলসির আওতায় রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমে গেছে। ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে রপ্তানির আদেশ কমে গেছে। ফলে রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমেছে। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৬ শতাংশই আসে বস্ত্র খাতের মাধ্যমে।
এর মধ্যে ‘ব্যাক টু ব্যাক’ এলসির আওতায় ৯৬ শতাংশ কাঁচামালই আমদানি করা হয় বস্ত্র শিল্প খাতে ব্যবহারের জন্য। ‘ব্যাক টু ব্যাক’ এলসির আওতায় রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এলসি খোলা কমেছে ৩২ দশমিক ৮২ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে আমদানি কমেছে ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ‘ব্যাংক টু ব্যাক’ এলসিসহ বাণিজ্যিকভাবে বস্ত্র খাতের কাপড় আমদানির জন্য গত অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে এলসি খোলা কমেছে ২৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে আমদানি কমেছে ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ। বীজ আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৬০ দশমিক ০৭ শতাংশ। আমদানি বেড়েছে ৮ দশমিক ৪১ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ডলার সংকটের কারণে এখন সব শিল্পেই কাঁচামালের সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ প্যাকেজিং, গ্যাঙ্গারসহ নানা দেশীয় শিল্প এখন কাঁচামাল সংকটে উৎপাদন করতে পারছে না। তাদের ডলার আয় না থাকায় এলসি খুলতেও পারছে না। এতে পোশাক শিল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে মন্দার কারণে পোশাক রপ্তানির অর্ডারও কমে গেছে। সব মিলে সামনে শিল্প খাতে একটি বড় সংকট আসছে। এটি মোকাবিলা করা উদ্যোক্তাদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য নীতি-নির্ধারকদেরও বসতে হবে। সহায়ক পলিসি গ্রহণ করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি এলসি খোলা কমেছে ২২ দশমিক ৪১ শতাংশ এবং আমদানি কমেছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। ফলে ওষুধ খাতেও উৎপাদন কমার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া ওষুধের একটি অংশ রপ্তানি হচ্ছে। এ খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে যেসব প্রতিষ্ঠান ওষুধ রপ্তানি করে ডলার আয় করতে পারছে না ওইসব প্রতিষ্ঠান এখন এলসি খুলতে পারছে না। রাসায়নিক ও এ জাতীয় পণ্য আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ। অন্যান্য কাঁচামালের এলসি কমেছে ৩৬ দশমিক ০৯ শতাংশ।
শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামালের সিমেন্টের এলসি খোলা কমেছে ৪৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আমদানি কমেছে ৩৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ক্লিংকার ও লাইম স্টোন এলসি কমেছে ১০ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং আমদানি কমেছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এতে নির্মাণ খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আগামীতে এর নেতিবাচক প্রভাব আরও বাড়বে। এছাড়াও বিপি শিট এলসি ৬৯ দশমিক ২৪ শতাংশ, আমদানি ২৭ দশমিক ৯১ শতাংশ, টিন প্লেটের এলসি ৭৬ দশমিক ১২ শতাংশ এবং আমদানি ৫৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ কমেছে। পুরোনো জাহাজ আমদানি এলসি ৬৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং আমদানি ৬৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ, লোহা ও ইস্পাত আমদানির এলসি ২৮ দশমিক ০২ শতাংশ কমেছে। লৌহবহির্ভূত বিভিন্ন খনিজ ধাতুর এলসি ৬৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং আমদানি ৬৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ কমেছে। এর প্রভাবে দেশের ইস্পাত ও রড তৈরির মিলগুলো উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কাঁচামালের অভাবে তারা শিল্পের বিভিন্ন ইউনিট বন্ধ রেখেছে। এছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট তো আছেই। এগুলোর দাম বাড়ার কারণেও উৎপাদন খরচ বেড়েছে প্রতি টন রডে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। পেপার ও পেপার বোর্ড আমদানির এলসি ২৩ দশমিক ২১ শতাংশ এবং আমদানি কমেছে ১৫ দশমিক ১১ শতাংশ। অন্যান্য আমদানির এলসি ৩১ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং আমদানি কমেছে ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ।