ঢাকার যানজট: নাগরিকদের দুর্ভোগ, স্টাফদের যুদ্ধ, এবং সমাধানের গল্প

ঢাকা শহর যেন প্রতিদিন এক যুদ্ধক্ষেত্র। মানুষ, গাড়ি, আর অসংখ্য হর্নের আওয়াজের মধ্যে আটকে থাকে জীবন। যানজট ঢাকার মানুষের জীবনের এক নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। এর পেছনে আছে নাগরিকদের হতাশা, পরিবহনকর্মীদের কষ্ট, এবং মালিকদের আর্থিক ক্ষতির এক জটিল জাল।জীবনের গতি থমকে যায় যেখানে মিরপুর ১-এর এক যাত্রী, সুমন আহমেদ, প্রতিদিন সকালে অফিস যাওয়ার জন্য বাস ধরেন। “বাড়ি থেকে অফিসের দূরত্ব মাত্র ১০ কিলোমিটার, কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। অনেক সময় অফিস মিটিংয়ে পৌঁছানোর আগেই মাথা গরম হয়ে যায়,” বলছিলেন সুমন।
তিনি আরও বলেন, “রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়, জীবনের অর্ধেক সময় তো এই জ্যামেই শেষ হয়ে গেল। ছেলে-মেয়েদের সময় দিতে পারি না, পরিবার মনে করে আমি ব্যস্ত, কিন্তু আসলে ব্যস্ত নই—ফাঁদে পড়েছি।বাসের স্টাফদের জীবনের কঠিন বাস্তবতা বাস চালক রবিউল ইসলামের জীবনের গল্প আরও কষ্টকর। “আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্টিয়ারিংয়ে বসে থাকি। দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় পাই না। জ্যামের কারণে যাত্রীরা রাগারাগি করে। বাসের মালিক সময়মতো ট্রিপ দিতে চাপ দেয়। এমনকি দিনে ১৪-১৫ ঘণ্টা কাজ করার পরেও যা বেতন পাই, তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন,” বললেন রবিউল।বাসের হেলপার আসিফ জানান, “রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি, যাত্রীদের চাপা কথা—সব মিলে আমাদের জীবনটাই এক যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে। একসময় মনে হয় চাকরি ছেড়ে গ্রামে চলে যাই। কিন্তু গ্রামে কী করব?বাস মালিকদের উদ্বেগ বাস মালিকদের জন্য যানজট আরেকটি দুঃস্বপ্ন। প্রতিদিন যানজটের কারণে তারা ঠিকমতো ট্রিপ দিতে পারেন না। অনেক সময় লাভ তো দূরের কথা, লোকসান গুনতে হয়। “আমরা যাত্রীদের সুবিধার জন্য আরও বাস নামাতে চাই, কিন্তু রাস্তাগুলোতে জায়গা নেই। যাত্রীরা সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না, আর আমরা ব্যবসার লাভ পাই না,” বলছিলেন এক পরিবহন মালিক, যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।এই জট ছাড়ানোর পথ যানজটের ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেতে কিছু বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।১. নাগরিকদের কাছে আবেদন:
সুমনের মতো অনেকেই মনে করেন, ট্রাফিক আইন মেনে চলার পাশাপাশি গণপরিবহন ব্যবহারে সবাইকে উৎসাহিত করতে হবে।“আমরা যদি একসঙ্গে রাইড শেয়ার করি, ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমাই, তাহলে হয়তো রাস্তা একটু ফাঁকা হবে। কিন্তু তার আগে প্রয়োজন ভালো গণপরিবহন ব্যবস্থা,” বলেন তিনি।
২. চালক ও স্টাফদের জন্য প্রশিক্ষণ:রবিউল মনে করেন, “চালক ও হেলপারদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ হলে এবং তাদের সঠিক বেতন ও কাজের সময় নির্ধারণ করা হলে পরিস্থিতি অনেক উন্নত হবে।৩. বাস মালিকদের বিনিয়োগ:বাস মালিকরা যদি আধুনিক ও আরামদায়ক বাস চালু করেন এবং নির্ধারিত ভাড়ার মধ্যে সেবা দেন, তাহলে মানুষ আরও বেশি পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ভরসা করবে।আবেগের গল্প: একটা বদলে দেওয়া শহরের স্বপ্ন বাসের হেলপার আসিফের কথায় একটা ভিন্ন আবেগ মেলে ধরা পড়ে। তিনি বলেন, “যানজটের কারণে আমরা মানুষকে গালমন্দ করতে দেখি। কিন্তু আমরা কি জানি, এই গাড়িগুলোয় কত স্বপ্ন আটকে থাকে? কেউ হয়তো হাসপাতালের পথে যাচ্ছে, কেউ ইন্টারভিউতে, কেউ প্রিয়জনের কাছে। যদি রাস্তা একটু ফাঁকা থাকত, সবাই হয়তো একটু হাসিমুখে চলতে পারত।এই গল্পগুলো কেবলই যানজটের শিকার কয়েকজন মানুষের নয়; এটি পুরো শহরের। সঠিক পরিকল্পনা, সরকারি উদ্যোগ, এবং মানুষের সচেতনতা ছাড়া এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব।উপসংহার ঢাকার যানজট কোনো সাধারণ সমস্যা নয়। এটি একটি জাতির উন্নতির পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা। আজ যদি আমরা একসঙ্গে কাজ করি, একদিন এই শহরটা তার হারানো গতি ফিরে পাবে। আর তখনই হয়তো রবিউল, আসিফ, এবং সুমনের মতো লাখো মানুষ একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারবে। একটাই স্বপ্ন—যানজটমুক্ত এক ঢাকা।