কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে জন্মগ্রহণকারী যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের স্টেট সিনেটর শেখ রহমান আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানসমূহকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়েছেন। যাতে অর্থবহ ও দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন নিশ্চিত করা যায়।
সম্প্রতি ঢাকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সিনেটর রহমান বলেন, “বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে, তবে এখনো নানা জটিল চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয় এবং দুর্নীতি সমাজের প্রায় সব খাতে গভীরভাবে প্রোথিত। এই সমস্যাগুলো সমাধান না হলে জনগণের জন্য প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়।”
তিনি আরও বলেন, অতীত সরকারের সময় যারা দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।
ব্যক্তিগত সফর ও ঈদ উদযাপন
৯৭ বছর বয়সী মায়ের সঙ্গে দেখা করতে ব্যক্তিগত সফরে বাংলাদেশে আসেন সিনেটর রহমান এবং ৪৫ বছর পর প্রথমবারের মতো তিনি কিশোরগঞ্জের সরারচর গ্রামে নিজের জন্মভূমিতে ঈদুল আযহা উদযাপন করেন। ২ জুলাই বুধবার তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান।কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক বৈঠক ঢাকা ও গাজীপুরে বাংলাদেশি ও মার্কিন কর্মকর্তাসহ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন সিনেটর রহমান।
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার অ্যাম্বাসাডর ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের সঙ্গে বৈঠকে তারা বাংলাদেশের প্রশাসনিক বা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সমন্বয়হীনতার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন, যা বিদেশি বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়। জ্যাকবসন বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
দূতাবাস সফরের সময় সিনেটর রহমান বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং তাদের কল্যাণ সম্পর্কে খোঁজখবর নেন।
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বাসভবনে বৈঠকে তিনি বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্ক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, যাকে তিনি ‘Disaster” বলে আখ্যায়িত করেন। জবাবে, সিনেটর রহমান বলেন, বাংলাদেশ এখন মার্কিন পণ্যের—বিশেষ করে স্বাস্থ্য, কৃষি ও প্রতিরক্ষা খাতে—আমদানি বাড়াচ্ছে এবং কৃষিপণ্যের আমদানির প্রতিবন্ধকতা কমাতে কাজ করছে।
তিনি বলেন, “আমাকে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একটি উৎস হিসেবে ব্যবহার করুন।”
তিনি আরও কিছু ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে নতুন শুল্ক নীতির প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন।
অবৈধ অর্থপাচার ইস্যুতে আলোচনা
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের পরিচালকসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি অবৈধভাবে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে আলাপ করেন। তিনি জানান, এফবিআইসহ মার্কিন সংস্থাগুলো সহায়তা করতে প্রস্তুত, যদি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে প্রস্তাব ও নথিপত্র জমা দেয়।
কারখানা পরিদর্শন ও সামাজিক সংযোগ
ঢাকার বাইরে গাজীপুরে দুটি পোশাক কারখানা সফর করেন তিনি, যেখানে শ্রমিক, মালিক ও ব্যবস্থাপকদের মধ্যে সমন্বয় দেখে তিনি প্রশংসা করেন।
ঢাকায় আমেরিকান ক্লাবে ‘স্টেট ফুড সানডে: জর্জিয়া অন মাই মাইন্ড’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দেন, যেখানে প্রবাসী বাংলাদেশি ও জর্জিয়াবাসীদের কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা পান।
তিনি বঙ্গভবনের আমন্ত্রণ ও অন্যান্য সরকারি বৈঠকের সময়সূচি থাকা সত্ত্বেও সময়ের স্বল্পতার কারণে সেগুলোতে অংশ নিতে পারেননি বলে জানান।
নির্বাচন ও প্রতিষ্ঠান সংস্কারের পক্ষে জোরালো অবস্থান
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সিনেটর রহমান বলেন, “শুধু নির্বাচনই যথেষ্ট নয়, এর আগে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগে কাঠামোগত সংস্কার অপরিহার্য।”
তিনি বলেন, “আমার নিজ এলাকাতেও রাজনৈতিক হয়রানির কিছু অভিযোগ এসেছে, যা গভীরভাবে উদ্বেগজনক।”
তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সই করতে এবং যেসব বহুপাক্ষিক সংস্থা বাংলাদেশের সদস্য, তাদের সহায়তা নিতে।
তিনি বলেন, “নির্বাচনের আগেই মূল সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। বাকি বিষয়গুলো নির্বাচনের পরবর্তী সরকার দেখবে।”
গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার প্রতি আহ্বান
সিনেটর রহমান বলেন, “শুধু একবারের জন্য নয়, আগামী ২৫-৩০ বছর ধরে শক্তিশালী গণতন্ত্র ও ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বচ্ছ প্রক্রিয়া বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”
তিনি বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ, আমলাচার ও ব্যবসায়ী নেতাদের সততা ও যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। “রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে হবে। শুধু যোগ্য ও নৈতিক ব্যক্তিদের জাতীয় দায়িত্বে রাখতে হবে,” তিনি বলেন।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উদ্বেগ
রোহিঙ্গা সংকটকে তিনি বাংলাদেশের জন্য এক গুরুতর মানবিক ইস্যু হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনো তার অনুরোধে সাড়া দেয়নি বলে জানান।
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা সংকট এখনো জরুরি, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অর্থায়ন কমে যাওয়ায়। বাংলাদেশ সরকার চাইলে আমি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো, বিশেষত মার্কিন সহায়তা বাড়ানোর ক্ষেত্রে।”
পরিবেশ সচেতনতা ও নাগরিক দায়িত্ব
সিনেটর রহমান বলেন, “বাংলাদেশে যেখানেই যাই না কেন, রাস্তাঘাটে আবর্জনা ছড়ানো দেখি। জনগণকেই সচেতনভাবে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে উদ্যোগ নিতে হবে। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ জীবনের মান বাড়ায় এবং পর্যটন উন্নয়নে সহায়ক।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। পরিবেশ যদি উন্নত হয়, আমি যুক্তরাষ্ট্রেও বাংলাদেশের পর্যটনকে প্রচার করতে আগ্রহী।”
পারিবারিক পুনর্মিলন ও আবেগঘন মুহূর্ত
সরারচরের নিজ গ্রামে এবং ঢাকার বাসায় তার আত্মীয়স্বজন, পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে পুনর্মিলনের এক আবেগঘন মুহূর্ত কাটান। ঢাকার এক কমিউনিটি সেন্টারে একত্র হয়ে সবাই খাবার ভাগাভাগি করেন এবং আনন্দ উপভোগ করেন। এই সফরকে তিনি “স্মরণীয় ও সেরা সফর” হিসেবে বর্ণনা করেন।
আইনসভার সমর্থন
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে জর্জিয়া স্টেট সিনেটর রহমানের প্রস্তাবিত এক রেজোলিউশন পাস করে। যেখানে বাংলাদেশের ২০২৪ সালের শিক্ষার্থী-নেতৃত্বাধীন কোটাবিরোধী আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক দাবিগুলোর প্রতি সংহতি জানানো হয়।রেজোলিউনটিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার উদ্যোগের প্রতি শুভকামনা জানানো হয়।
উল্লেখ্য, বর্তমানে যুক্ত রাষ্ট্রের টেক্সাস বিদ্যালয় সান এন্টোনিও(UTSA) এ যোগাযোগ বিদ্যায় অধ্যয়নরত সাবেক ইউএনবির প্রতিনিধি ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক মোঃ ওয়াসিম ভুঁইয়া এ তথ্য জানিয়েছেন।