যুবসমাজের সংকট: কোন পথে মুক্তি?
মো. খালেকুল ইসলাম
বর্তমান সমাজে আমাদের তরুণ প্রজন্ম নানা ধরনের সমস্যায় জর্জরিত। মাদকাসক্তি, অবক্ষয়, হতাশা এবং নৈতিক অবক্ষয়ের মতো চ্যালেঞ্জ তাদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। আমরা প্রায়ই শুনি—"আমাদের যুবসমাজ বিপথগামী হচ্ছে, কিন্তু কেন?" গভীরভাবে চিন্তা করলে এর প্রধান কারণ দু’টি: ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব ও সমাজের নৈতিক অধঃপতন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে খারাপ বন্ধুদের প্রভাব ও নেশার সামগ্রীর সহজলভ্যতা।
এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় কী? আমাদের কী করা উচিত? আসুন, বিশ্লেষণ করি।
যুবসমাজের অবক্ষয়ের কারণ
১. ধর্ম থেকে দূরে সরে যাওয়া
একটি সমাজের ভিত্তি হলো তার নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ বাবা-মা সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে শুধুমাত্র একাডেমিক সাফল্যের দিকে বেশি মনোযোগী। ফলে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন—
"সবচেয়ে উত্তম উত্তরাধিকার হলো সন্তানকে সুশিক্ষিত করা।" (তিরমিজি)
কিন্তু আজকের দিনে ধর্মীয় শিক্ষাকে স্কুল-কলেজে "গৌণ" বিষয় হিসেবে ধরা হয়। ফলে তরুণরা জানতেই পারে না যে, কীভাবে সঠিক পথে চলতে হবে, কীভাবে নিজের জীবনকে অর্থবহ করতে হবে।
২. সমাজ যখন বিষাক্ত হয়ে ওঠে
বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া, টিকটক, ফেসবুক, ইউটিউব—সব জায়গায় নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র স্পষ্ট। গানের ভিডিও, সিনেমা ও সিরিয়ালে এমন সব বিষয় তুলে ধরা হয়, যা তরুণদের মস্তিষ্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
কুরআনে আল্লাহ সতর্ক করে বলেছেন—
"হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের ও পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।" (সূরা তাহরিম: ৬)
কিন্তু আমরা কি তা করছি?
৩. খারাপ বন্ধু + সহজে নেশার প্রবণতা
বন্ধুদের প্রভাব জীবনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অনেক তরুণ শুধু বন্ধুর চাপে পড়ে প্রথমবার নেশা গ্রহণ করে। সিগারেট, গাঁজা, ইয়াবার মতো মাদকদ্রব্য আজ সহজলভ্য। রাস্তার ধারে পাওয়া যায়, হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়, এমনকি অনলাইনের মাধ্যমে অর্ডার করাও সম্ভব! এই সহজলভ্যতা আমাদের যুবসমাজকে গভীর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
উপায় কী? কীভাবে যুবসমাজকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব?
যুবসমাজকে সঠিক পথে ফেরাতে কেবল লেকচার বা উপদেশ নয়, দরকার বাস্তবিক পদক্ষেপ।
১. ঘর থেকেই শুরু হোক পরিবর্তন
- সন্তানদের হাতে প্রথম বই হোক কুরআন। ছোটবেলা থেকেই তাদের নামাজের প্রতি আগ্রহী করে তুলুন।
- ঘরে ইসলামিক পরিবেশ তৈরি করুন। নবী-রাসুলদের গল্প শোনান, ইসলামিক কার্টুন দেখান, ইসলামি আলোচনা করুন।
- বাবা-মা নিজেরাই হোন রোল মডেল। যদি আপনারাই সারাক্ষণ ফোনে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে সন্তানদের কাছ থেকে কী আশা করা যায়?
২. সমাজের দায়িত্ব
- মসজিদকে যুবকদের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলুন। ইমাম সাহেবদের বলুন, যেন তারা তরুণদের জন্য বিশেষ আলোচনা আয়োজন করেন।
- এলাকায় নেশার দোকান ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলুন।
- গান-সিনেমার বদলে ইসলামিক কনটেন্ট শেয়ার করুন সোশ্যাল মিডিয়ায়, যাতে তরুণরা সঠিক শিক্ষা পেতে পারে।
৩. ভালো বন্ধু নির্বাচন করা শিখতে হবে
রাসুল (ﷺ) বলেছেন—
"লোকে তার বন্ধুর ধর্মের অনুসারী হয়।" (আবু দাউদ)
ভালো বন্ধু চেনার সহজ উপায়:
- যে ব্যক্তি নামাজের কথা মনে করিয়ে দেয়, সে-ই প্রকৃত বন্ধু।
- যে আপনাকে খারাপ পথে নিয়ে যায় না, সে-ই প্রকৃত বন্ধু।
৪. নেশা মুক্তির ইসলামি পদ্ধতি
- নেশার জন্য যে টাকা ব্যয় হতো, তা গরিবদের দান করুন।
- নিজেকে ব্যস্ত রাখুন—খেলাধুলা করুন, নতুন দক্ষতা শেখার চেষ্টা করুন, বই পড়ুন।
- আল্লাহর কাছে সাহায্য চান, ইস্তেগফার করুন, বেশি বেশি দোয়া করুন:
"হে আল্লাহ! আমার অন্তরকে তোমার স্মরণে পরিপূর্ণ করো।"
যুবসমাজকে বাঁচাতে হলে শুধু উপদেশ নয়, প্রয়োজন বাস্তব পদক্ষেপ ও ভালোবাসা। আমাদের মনে রাখতে হবে—এই তরুণরাই আগামীর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, নেতা। তাদের সঠিক পথে আনতে হলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে একযোগে কাজ করতে হবে।
রাসুল (ﷺ) সাহাবিদের যেভাবে গড়ে তুলেছিলেন, আমাদেরও তেমনভাবে চেষ্টা করতে হবে। আসুন, আমরা সবাই মিলে যুবসমাজকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করি।
আজই একটি পদক্ষেপ নিন—আপনার ভাই, বন্ধু বা সন্তানকে কিছুটা সময় দিন, তার পাশে দাঁড়ান। হতে পারে, আপনার একটি কথাই তার জীবন বদলে দেবে।