এতে করে প্রতি মাসে শুধুমাত্র হারাগাছ এলাকা থেকে প্রায় ৭৭ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অভিযোগ রয়েছে, এসব কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছেন কাস্টমস বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। তারা এই অবৈধ কারবারে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। যোগসাজস থাকায় নকল, জাল ও ব্যান্ডরোল বিহীন বিড়ির কারখানা ও বিক্রি বন্ধে দৃশ্যমান কোন অভিযান চোখে পড়ে না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্যান্ডরোলবিহীন, নকল ও জালসহ বিভিন্ন নামে বিড়ি তৈরি বাজারজাতকরণে কোন আইন ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছেন না অবৈধ বিড়ি তৈরির মালিকরা। অধিক মুনাফা ও ব্যান্ডরোলবিহীন বিড়ি বাজারজাতের জন্য যেমন ডালা, ক্যাবিনেট, বিভিন্ন ধরনের প্যাকেট ডিসপ্লে, কুপন, নগদ টাকা, লুঙ্গি, গামছাসহ বিভিন্ন লোভনীয় জিনিসপত্র দোকানদেরকে দেয়া হচ্ছে।
একারণে দোকানদাররাও ভালো মন্দ বিচার না করে এই অবৈধ বিড়িগুলো বিক্রি করছেন। এই বিড়ি ধুমপান করার কারণে ভোক্তারাও অধিকতর ঝুঁকিতে পড়ছেন। মাঠপর্যায়ের কিছু অসাধু রাজস্ব কর্মকর্তা নকল ব্যান্ডরোল কারবারকে উৎসাহিত করে চলেছেন। বিশেষ করে যাচাই-বাছাই ছাড়া অনলাইনে বিড়ি ফ্যাক্টরির লাইসেন্স দেওয়ায় তারা সরকারি ব্যান্ডরোল ক্রয় না করে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে ভুয়া ব্যান্ডরোল দিয়ে বিড়ি-সিগারেট বাজারজাত করে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন। এসব কারণে সরকারও প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে দুদক ও এনবিআরের পাশাপাশি নকল ব্যান্ডরোল ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের ৪৩.৩ শতাংশ মানুষ তামাকজাতদ্রব্য ব্যবহার করে আসছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিয়ম অনুসারে ১ প্যাকেট বিড়ির দাম ১৮ টাকার নিচে বিক্রি করা হলে সেসব বিড়িগুলো জাল ও অবৈধ। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রংপুর বিভাগে প্রতিদিন বৈধ অবৈধ মিলে প্রায় ১ কোটি শলাকা বিড়ি বাজারজাত হয়। এর মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ বিড়ি সরকারি রাজস্ব মেনে বাজারজাত করা হয়।
বাকী ৭০ ভাগ বিড়িই নকল, জাল ও ব্যান্ডরোলবিহীনভাবে বাজারজাত হয়ে আসছে। হিসাব অনুযায়ী, ৭০ ভাগ অর্থাৎ ৭০ লক্ষ শলাকা বিড়ি। ১ প্যাকেটে ২৫টি বিড়ি থাকে। সেই মোতাবেক ৭০ লক্ষ শলাকায় ২ লক্ষ আশি হাজার প্যাকেট হয়। একারণে সরকার প্রতি মাসে শুধুমাত্র হারাগাছ এলাকা থেকে প্রায় ৭৬ কোটি ৩৫ লাখ ০৬ হাজার টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। এই পরিসংখ্যানটি বৈধ বিড়ি ব্যবসায়ীদের হলেও সারাদেশের সার্বিক বিবেচনা আসলে রাজস্বের ক্ষতি আরও কয়েকগুন বৃদ্ধি পাবে। সরেজমিনে দেখা গেছে, রংপুরাঞ্চলের বাজারগুলোতে নামে বেনামে কমপক্ষে প্রায় ৬০টিরও অধিক নকল, জাল ও ব্যান্ডরোবিহীন বিড়ি ছোট বড় দোকান গুলোতে পাওয়া যাচ্ছে। এসব বিড়ি রংপুরের হারাগাছ ও তার আশপাশের পাড়াগুলোতে তৈরি করা হচ্ছে। এই অবৈধ বিড়িগুলো কাস্টম কর্মকর্তা, কর্মচারী ও স্থানীয় প্রশাসন ম্যানেজ করে তাঁদের নাকের ডগার উপর দিয়ে বাইসাইকেল ও মোটরসাইকেলে করে বহন করে বাজারজাত করা হচ্ছে।
তারা বিড়িগুলো ছোট বড় দোকানগুলোতে ২৫ শলাকার ১ প্যাকেটের দাম ৩ টাকা ৫০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ৬ টাকায় বিক্রি করছে। আর দোকানদারা বিক্রি করছেন ৫ টাকা থেকে ৭ টাকায়। আবার বিড়ির প্যাকেটগুলো সহজেই বাজারজাত করতে অবৈধ ব্যবসায়ীরা নিশ্চিত পুরুস্কার হিসেবে প্যাকেটের ভিতর ২ টাকাসহ অন্যান্য পুরুষ্কার দিচ্ছেন। এতে ছোট বড় দোকানদাররা অতি উৎসাহিত হয়ে ওই অবৈধ বিড়িগুলো বিক্রি করছেন। এই বিড়িগুলো নকল, জাল ও ব্যান্ডরোল বিহীন। গংগাচড়া উপজেলার বেতগাড়ী বাজারের ব্যবসায়ী আনছার আলী জানান, আমি তো নকল, জাল ও ব্যান্ডরোলবিহীন বিড়ি বুঝি না। কম দামে বিড়ি ক্রয় করে ২ থেকে ৩টাকা লাভ করে বিক্রি করি। বিভিন্ন বিড়ির মালিকরা নিয়মিত আমাদের দোকানে তা সরবরাহ করে। ব্যবসায়ী মোঃ ফারুক মিয়া জানান, প্রতিদিন বিভিন্ন কোম্পানীর লোকজন আমার দোকানে আসে, তাদের বিড়ি বিক্রির কথা বলে। আমি যে বিড়ি কমদামে পাই তা বিক্রি করি। আমি তো আর আইন কানুন বুঝি না। বাংলাদেশ বিড়ি মালিক সমিতির সহ-সভাপতি ও রংপুর জেলা সভাপতি মজিবর রহমান জানান, নকল, জাল ও ব্যান্ডরোলবিহীন বিড়ি তৈরি বন্ধে আমাদের করনীয় কিছু নেই। আমরা কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে বরাবরই এবিষয়ে তাগিদ দিয়ে আসছি, তারা যেন অভিযান চালিয়ে এসব বিড়ি বন্ধ করে দেন।
রংপুর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট বিভাগীয় কমিশনার জানান, যারা আইন অমান্য করছে ও রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে কাস্টমস বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারী জড়িতের বিষয়টি এড়িয়ে যান। রংপুর জেলা প্রশাসক আসিফ আহসান মুঠোফোনে জানান, নকল ব্যান্ডোলের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। এ জন্য টাস্কফোর্স টিম গঠন করা হয়েছে। যদি কোন তথ্য পাই সেক্ষেত্রে আমরা সাথে সাথে অভিযান পরিচালনা করি। আর উপজেলা পর্যায়ের দোকানগুলো থেকে ডালা, ক্যাবিনেট ও বিভিন্ন ধরনের প্যাকেট ডিসপ্লে বন্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের দিয়ে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।