ভাণ্ডারী দর্শন সুফী সভ্যতা বা নৈতিক মানবধর্মের আদর্শ দ্বারা মহিমান্বিত। ফলে ভাণ্ডারী গান জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মন জয় করেছে সহজেই। বাংলা গানের ইতিহাস হাজার বছরের। তবে ভাণ্ডারী গানের উদ্ভব সোয়া শ’ বছর আগে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি মোকামের মহান ধর্মসাধক হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (১৮২৬-১৯০৬) প্রবর্তিত মাইজভাণ্ডারী তরিকার সাধনমার্গের অনুপম অনুষঙ্গ হিসাবে ভাণ্ডারী গানের উদ্ভব। অথচ শতবর্ষের পরিক্রমায় ভাণ্ডারী গান সাধনমার্গের সীমাবদ্ধ গণ্ডি অতিক্রম করে বাংলার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক চাহিদা পূরণে সমর্থ হয়েছে, বাংলা লোকসংগীতে এক ব্যতিক্রমী ও অভূতপূর্ব ধারা সৃষ্টি করেছে এই গান। ভক্তদের কাছে ভাণ্ডারী গান যেন প্রেমসাগরের অরূপরতন, ভালোবাসার এক অলৌকিক শিল্প।
তেমনি একজন গুণী ব্যক্তির খোঁজ নিতে হাজির হলাম চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়, যিনি ১৫ হাজার ভান্ডারী গানের গীতিকার ও সুরকার। এক কথায় ভান্ডারী গানের ভান্ডার গচ্ছিত আছে যার কাছে। প্রচন্ড রোদের তাপে দাবদাহ উপেক্ষা করে বেরিয়ে পারলাম বাইক নিয়ে। সরফভাটা ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ড মীরেরখীল এলাকায় পৌঁছে চোখে পড়ল কাঙ্খিত সে গুণী ব্যাক্তির বাড়ি, বাড়ির দেয়ালে খোদাই করা লেখা রয়েছে ডাক্তার নুরুল আলম নুরী, বিশিষ্ট গীতিকার ও সুরকার, বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম।
তখন ঘড়ির কাটা বারোটা ছুয়ে ছুয়ে বাড়িতে ঢুকতেই দেখি হারমোনিয়ামের সুরে ভান্ডারী গান গেয়ে চলেছেন ডা নূরী।
বলছিলাম চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা ইউনিয়নের বাসিন্দা ডাক্তার নুরুল আলম নুরীর কথা যিনি ১৫ হাজার অধিক ভান্ডারী গানের গীতিকার ও সুরকার। মীরেরখীল প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান দরবেশ আলী ও রহিমা বেগমের সন্তান ডা নুরুল আলম নুরীর বয়স এখন ৭৫ এ ছুঁই ছুঁই। ছোটবেলা থেকে অনেক গুণের গুণাবলি নিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি, একাডেমিক কার্যক্রম শেষে Diploma of Medical Faculty Degree সম্পূর্ন করে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা সেবা দিয়ে বেড়াতেন। মানবিক চিকিৎসক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠে ডা নূরী। ৪০ বছর আগ থেকে শুরু করেন গান লেখার কাজ এবং গেয়ে শোনাতেন বন্ধুবান্ধব ও এলাকাবাসীর মধ্যে তখন থেকে ভান্ডারী গানের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়ে সে থেকে লেখা শুরু করেন আজ অব্দি ১৫ হাজারের অধিক গান লিখেছেন তিনি। এক সময় কাগজে লিখতেন আবার কাগজগুলো কোথাও হারিয়ে ফেলতেন তাই ঠিক করেন ডায়েরিতে গানগুলো লিপিবদ্ধ করবেন। এ পর্যন্ত ৩৯ ডাইরিতে তাঁর গানের ভান্ডার লিপিবদ্ধ আছে। সাত সন্তানের জনক ডাক্তার নুরুল আলম নুরী দরিদ্রতায় গ্রাস করে করলেও থেমে নেই তার গান লেখা এবং গুনগুন করে সুর বানাতেন। হাঁটতে চলতে ফিরতে গান বাঁধেন সুর করেন, এমনকি রাতে ঘুমানোর সময়ও তিনি গুনগুন করে গান বানিয়ে ফেলেন। এ পর্যন্ত ডাক্তার নূরীর গান দিয়ে অনেকেই কুড়িয়েছেন সুনাম, জননন্দিত হয়েছে ভান্ডারী গানের শিল্পী হিসেবে।
১. আজমীরেতে দয়াল খাজা কি খেলা খেলায়, আয়না সাগরের পানি ভরিলো লোটায়
২. তরিকতের নৌকা খানি মোহছেন আউলিয়া মাঝি
৩. ফুলের মালা গাঁথি রাইক্কি পেতন শাহর লে
গান গুলোর মত আরো অনেক বিখ্যাত গানের জনক ডা নুরুল আলম নূরী।
কিন্তু এই গুণী গীতিকারের নাম কিছু অ্যালবামে আসলেও প্রচার প্রসারের না থাকায় অগোচরে অচেনাই রয়ে গেছে তাঁর কাল জয়ী গানের সুখ্যাতির রচনা।
ভাণ্ডারী গানের মহৎ রচয়িতা হলেন মওলানা আবদুল হাদী কাঞ্চনপুরী, কবিয়াল রমেশ শীল ও আবদুল গফুর হালী। তাঁরা তিনজন তিন কালের মহান পদকর্তা। মওলানা হাদীকে মাইজভাণ্ডারী গানের উদ্ভাবক বলা হয়। এছাড়াও আঞ্জুমানে মাইজভাণ্ডারী সাংস্কৃতিক সূত্র থেকে জানা যায়, শতাব্দীকাল ধরে শতাধিক গীতিকারের প্রায় ৫ সহস্রাধিক ভাণ্ডারী গানের মধ্যে ১১৮ টি বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে এ পযর্ন্ত। তার মধ্যে ৮৬টি বইয়ে গানের সংখ্যা ৪৪৮৮টি। এ ছাড়া পাণ্ডুলিপি সংগৃহীত হয়েছে পাঁচটি, যাতে গান রয়েছে ৩২৮টি। সব মিলিয়ে সংগৃহীত গানের সংখ্যা ৪৮১৬টি পাওয়া যায়। কিন্তু ডা নরুল আলম নূরীর ১৫ হাজারের অধিক গানের গীতিকার ও সুরকার যা এ যাবত সংরক্ষনে রেকর্ড করা হয়েছে, এর চেয়ে তিন গুণ বেশি গান তাঁর ডাইরিতে লিপিবদ্ধ আছে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি গানের গীতিকার গাজী মাঞ্জারুল আনোয়ার গত ৬০ বছরে ২০ হাজার গানের লিখেছেন। সে রেকর্ডটি ভাঙতে চায় ডাক্তার নুরুল আলম নুরী। তারই প্রমাণ পাওয়া যায় আমাদের সামনে উৎপলিত আলোর রশ্নি দেখে, আমাদের সাথে কথা বলতে বলতে ইনস্ট্যান্ট লিখে ফেলল একটি গান। গত দুই বছর অসুস্থতার কারণে তার বিছানায় সাথে সম্পর্ক হয়ে গেলেও থেমে থাকেনি তার লিখনি। এ যেন তাঁর ভান্ডার বিষাদ থেকে বিষাদবৃক্ষ হচ্ছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, ভাণ্ডারী গানের সম্মোহনী শক্তির নেপথ্যে রয়েছে অসাম্প্রদায়িক মানবধর্মের চেতনা। আর এই চেতনার মূল উপজীব্য হলো সিমা (সেমা) মাহফিল বা গানবাজনা। পল্লী কবি জসীমউদ্দীন তাঁর মৃত্যুর পরে পল্লী কবিতে ভূষিত হয়েছেন চিনেছেন পৃথিবীর মানুষ। আমি হয়তো বেঁচে থাকা অবস্থায় আমার কষ্টের অর্জিত ফসল সম্মাননা পাবনা, অদূর ভবিষ্যতে যখন আমি থাকবো না তখন হয়তো সম্মাননা পাব।
অবাক হয়েছি গীতিকারের এলাকায় খোঁজ নিয়ে যাওয়ার সময়, এরকম একজন গুণী ব্যক্তিকে নিজের এলাকায় অনেকেই চিনে না যার লেখা গান শিল্পীর মুখে গিয়ে শোনালে বিনোদনের চিত্তে নেচে গিয়ে আয়োজন মুখরিত করে সেই ব্যক্তিটি অচেনা প্রজন্মের কাছে। ২০১১ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রামের গীতিকার হিসেবে লিস্টে অনুমোদন পেলেও অসুস্থতার কারণে আসা যাওয়া না থাকায় নিজের কালজয় বিখ্যাত সব গানের গীতিকার হিসেবে প্রমাণ দিতে পারেননি। অচেনা মানুষ অচেনাই রয়ে গেল আজও অজপাড়া এ গ্রামে।
ডাক্তার নুরুল আলম নুরীর বড় ছেলে সুজন বলেন, এখনো তাদের বাড়িতে বড় বড় শিল্পীদের পদচারণায় আনাগোনা দেখা যায়, পদধূলি নেয় তাঁর বাবার। তথমধ্যে উল্লেখযোগ্য কল্যাণী ঘোষ, জানে আলম, কল্পনা লালা, আবদুল মান্নান, আহমদ নূর আমিরী, ইদ্রিস কাওয়াল, সেলিম নিজামী, গীতা আচার্য, শিমুল শীল, বাচ্চু কাওয়াল, সৈয়দ নাসির উদ্দিন, বাদশা কাওয়াল, শরীফ উদ্দিন, মুন ও নয়ন শীল প্রমুখ। যারা ইতোমধ্যে অভূতপূর্ব ভক্তদের ভালবাসায় প্রেমসাগরের সুনাম অর্জন করেছে এমন কি তার লেখা গান দিয়ে অনেকই আজ ভাণ্ডারী গানের চাহিদাসম্পন্ন শিল্পীর ক্ষেতি অর্জন করেছে। তারা আজ বিভিন্ন ওরশে তুমুল জনপ্রিয় শিল্পী।
তার পরিবারের দাবি তার লেখা গানগুলো ভান্ডারী গানের অঙ্গনে যেন লিপিবদ্ধ থাকে জীবনের শেষ বয়সে যেন তাকে সম্মাননা জানানো হয়।
ভাণ্ডারী দর্শন অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মানবধর্মের মাহাত্ম্য দ্বারা পরিচালিত বলে ভাণ্ডারী গানও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি তথা বিশ্বমানবের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষুধা নিবারণ করছে। তাই ভাণ্ডারী গান আজ বাংলা লোকসংগীতের অপরূপ ধারা, যা একান্তই চট্টগ্রামের নিজস্ব সম্পদ। ভাণ্ডারী গান চাটগাঁইয়া সংস্কৃতির লালিত পুষ্প, যার সৌরভে মোহিত বিশ্বচরাচর। বেঁচে থাকুক ভান্ডারী গান মুখরিত হোক ভান্ডারী গান লিখেছেন যারা সংস্কৃতিক অঙ্গনে সুবাস ছড়াক ডাক্তার নুরুল আলম নুরীর মত মানুষ গুলো।