বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসারে শব্দের স্বাভাবিক মাত্রা ৫৫ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় যা ৭০ ডেসিবল, যখন শব্দের মাত্রা ৮০ ডেসিবলের অতিক্রম করে তখন তাকে শব্দ দূষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

পরিবেশ দূষণের কথা আসলে আমাদের মনে পানি, বায়ু আর মাটির দূষণের কথা চলে আসে। কিন্তু শব্দ দূষণের কথা এতোখানি ভাবিনা। আর তাই হয়তো শব্দ দূষণ রোধে আমরা এতোটা পিছিয়ে আছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসারে শব্দের স্বাভাবিক মাত্রা ৫৫ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় যা ৭০ ডেসিবল, যখন শব্দের মাত্রা ৮০  ডেসিবলের অতিক্রম করে তখন তাকে শব্দ দূষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শব্দ দূষণের উৎপত্তি হয় মোটরসাইকেল, বাস, ট্রেন, ট্রাক, স্টিমার, লঞ্চ, জাহাজ এর হর্ন, কল-কারখানা, যুদ্ধ বিমান, জেট বিমানের যন্ত্রাংশ ও গতির শব্দ, বাদ্যযন্ত্র ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড, মেঘের গর্জন, জনসমাগম, ইত্যাদির মাধ্যমে। শব্দ দূষণের ফলে মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়।

যেমন বধিরতা, রক্তনালীর সংকোচন, হৃদপিন্ড থেকে নির্গত রক্তের পরিমাণ কমে যাওয়া, শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিকাশ বিঘ্ন হওয়া, অস্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস, স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া এবং  মেজাজ খিটখিটে থাকাসহ নানান রোগে মানুষকে ভুগতে হয়। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপির প্রতিবেদন অনুযায়ী শব্দ দূষণের দিক থেকে রাজধানী ঢাকা বিশ্বে প্রথম। আর এই প্রথম স্থান একটি বড় সতর্ক বার্তা দিচ্ছে, যে বার্তা আমরা বুঝেও অবুঝের মত আচরণ করছি। আর তাই আমাদের প্রিয় শহর ঢাকায় শব্দের মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল। গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ ২০২২ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, পরিবেশ দূষণের কারণে ২০১৯ সালে বিশ্বে প্রায় ৯০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়, যেখানে বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা ২ লক্ষ, আর যারা নিয়মিত মহাসড়কে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত যেমন ট্রাফিক পুলিশ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ অন্য পেশার মানুষের মধ্যে ৫৬ শতাংশ মানুষ কানে কম শোনেন।

বাংলাদেশে পরিবেশ বিষয়ে বেশ কিছু অধিক আইন রয়েছে, কিন্তু এই আইনগুলোর প্রয়োগ তেমন দেখা যায় না। ১৯৯৭ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুসারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ সরকার নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে মাইকিং বা হর্ন বাজানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ শব্দ দূষণ নীতিমালা  অনুযায়ী শহরকে ৫ভাগে বিভক্ত করা হয় এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে দিবা ও রাত্রির জন্য শব্দের আলাদা মাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে, যা অমান্য করা দন্ডনীয় অপরাধের সামিল। কিন্তু আমাদের চারপাশে দিব্বি এসব আইন অমান্য করা হচ্ছে, তবে নেই কোনো আইনি পদক্ষেপ। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সংস্থা (বেলা) শব্দ দূষণের লাগাম টানতে আদালতে একটি রিট পিটিশন দায়ের করে, যার ফলশ্রুতিতে উচ্চ আদালত হাইড্রোলিক হর্ন সেইসাথে বিকট শব্দ সৃষ্টিকরে এমন সকল হর্ন যানবাহনে ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন কিন্তু আমাদের নামীদামী পরিবহণে এমন হর্নের ব্যবহার প্রায়ই লক্ষ করা যায়।

অন্যদিকে ১৯৭৬ সালের ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ –এর ধারা ২৫, ২৭ ও ২৮ এ শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কারাদন্ড ও অর্থদন্ড অথবা উভয়েরই বিধান রয়েছে। এছাড়াও মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর ১৩৯ এবং ১৪০ ধারায় সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ এমন হর্ন ব্যবহারের শাস্তি হিসেবে কারাদন্ড ও অর্থদন্ডের বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের ৪৬ ধারার উপধারা ৩ এ পরিবেশ দূষণ হয় এমন কোনো যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ মোটরযানে ব্যবহার করা যাবে না বলা হয়েছে, একই ধারার ৪নং উপধারায় ঝুঁকিপূর্ণ, ত্রুটিপূর্ণ বা মহাসড়কে চলাচলের অনুপযোগী মোটরযান চালনার অনুমতি দেওয়া যাবে না বলা হয়েছে অথচ ফিটনেস বিহীন হাজারো যানবাহন আমাদের শহরে নিতান্তই চলছে। এসকল বিষয় আমাদেরকে যে ইঙ্গিত দিচ্ছে তা হলো আইনের প্রতি আমাদের অবহেলা, কারণ আইন আছে পুস্তকে কিন্তু নেই বাস্তবায়নে। আর যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আশঙ্কা অনুযায়ী বিশ্বে ১২-৩৫ বছর বয়সী ১১০ কোটি কিশোর-যুবা বধির হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে আছে তা বাস্তবে রুপ নিবে।

এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সচেতনতা বৃদ্ধির করা, অন্যথায় জন্মদিন, বিয়ে আর গায়ে হলুদের নামে লাউড স্পিকারে রাতভর গান চলবে, মাইক দিয়ে নির্বাচনি প্রচারণা চালাবে, রাস্তায় কারণে অকারণে হর্ন বাজাবে। গবেষণায় দেখা গেছে কিছু প্রজাতির গাছ আছে যেগুলো অধিক পরিমাণে শব্দ শোষণ করতে পারে, যেমন তেতুল, অশোক, নারকেল, বট, দেবদারু, নিম ইত্যাদি। এই ধরনের গাছ রাস্তা বা শিল্প এলাকায় রোপণ করা যেতে পারে। আবার শব্দের মধ্যে সারাক্ষণ কাজ করতে হয় এমন শ্রমিকদের জন্য নরওয়ের মতো ‘কোয়েটপ্রো' প্রযুক্তিও ব্যবহার করা যেতে পারে, যা ১২০ ডেসিবলের শব্দকে শ্রবণ উপযোগী করতে ৩০ ডেসিবলে নামিয়ে আনতে পারে। তবে এই প্রযুক্তির অনেক ব্যয় বহুল।  একটি বিষয় পরিষ্কার যে আমাদের দেশে অনেক আইন রয়েছে বিশেষ করে যথাযথ আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে অনেকাংশে শব্দ দূষণ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।