ছাত্রজীবন থেকেই ইচ্ছে বড় হয়ে গ্রামীণ মানুষের চিকিৎসাসেবার জন্য কিছু করার। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে কষ্টে শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন। প্রথমে ৫ বছর চাকরি করেছেন; এরপর শুরু করেন ব্যবসা।

রোজগারের শুরু থেকে সংসারের খরচ কমিয়ে প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট টাকা ব্যাংকে জমা রাখতেন। এভাবে ১৫ বছরে জমা করা টাকায় নিজ বাড়ির সামনে ৫০০ বর্গফুট জমিতে তৈরি করেন একটি পাকা ভবন। সেখানে গত ২৩ মে মা-বাবার নামে চালু করেন ‘আহমদ সুফিয়া দাতব্য চিকিৎসালয়’। হাসপাতালে সপ্তাহে এক দিন প্রতি সোমবার গরিব রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ দেওয়া হয়। উদ্বোধনী দিনে ২৭ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রায় ১০০০ রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেন। বর্তমানে প্রতি সোমবার অর্ধশত রোগী চিকিৎসা নেন। 
এই মানবিক কাজের উদ্যোক্তা হলেন সাতকানিয়া পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্য রূপকানিয়া এলাকার বাসিন্দা ফয়সল মুহাম্মদ ইউনুস।  
গত সোমবার সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, একটি পাকা ভবনের মাঝখানের একটি কক্ষে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগী দেখছেন। ওই চিকিৎসককে সহায়তা করছেন একজন নার্স। রয়েছেন দুজন সহকারীও। তারা রোগীর চাহিদা মতো দিচ্ছেন বিনামূল্যের ওষুধ। তাৎক্ষণিক ডায়াবেটিস ও প্রেসার পরীক্ষা করছেন। এ ভবনের দক্ষিণে আরেকটি কক্ষে বসে আছেন ২০-২৫ জন রোগী। বেশির ভাগই নারী ও শিশু। কক্ষে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় অনেক রোগী বাইরে অপেক্ষা করছেন। 
সন্তানের জ্বর, সর্দি ও কাশির চিকিৎসা নিতে এসেছেন পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্য রূপকানিয়া এলাকার বাসিন্দা রহিমা বেগম। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসক খুব যত্ন সহকারে আমার ছেলেকে দেখেছেন। কোনো টাকা নেননি। বিনামূল্যে দিয়েছেন প্রয়োজনীয় ওষুধ।’
প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরের এওচিয়া ইউনিয়নের ওয়াহিদের পাড়া থেকে বাতের চিকিৎসার জন্য এসেছেন ৬২ বছর বয়সী মমতাজ বেগম। তিনি বলেন, ‘আমি তৃতীয় বারের মতো চিকিৎসা নিতে এসেছি। আগে অসুস্থতার কারণে চলাফেরা করতে পারতাম না। এখন অনেকটা সুস্থতা বোধ করছি।’ মধ্য রূপকানিয়ার মনু সিকদারপাড়া থেকে পায়ের ব্যথা নিয়ে এসেছেন দিলোয়ারা বেগম ও আমিন শরীফ। তারাও চিকিৎসায় উপকার পেয়েছেন বলে জানান।
ডায়াবেটিস ও প্রেসারের চিকিৎসা নিতে এসেছেন ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বিলকিস খাতুন (৬৫।তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকায় এ হাসপাতালটি চালু হওয়ার পর থেকে আমি প্রতি সপ্তাহে  শরীর চেকআপ করি। এখানে চিকিৎসার জন্য কোন টাকা নেওয়া হয় না। এলাকার গরিবরা উপকৃত হচ্ছেন।’
এলাকাবাসী জানান, পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড মধ্য রূপকানিয়া থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দূরত্ব প্রায় ৩ কিলোমিটার। এছাড়া এ ওয়ার্ডের কাছাকাছি নেই কোন এমবিবিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসক। তাৎক্ষণিক কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে নিতে হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অথবা ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরত্বের কোন বেসরকারি হাসপাতালে। অনেক সময় জরুরি কোন রোগী পথের মধ্যে বেশি অসুস্থ অথবা মারাও যায়। অন্তত: এ চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে যদি প্রাথমিক চিকিৎসাটা পাওয়া যায় তাহলে অনেক রোগী বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে পারে।
এ চিকিৎসালয়টি পরিচালনায় জন্য রয়েছে একটি কমিটি। আট সদস্যের এ কমিটিতে ফয়সল মুহাম্মদ ইউনুস চেয়ারম্যান, তাঁর স্ত্রী তাসলিমা সুলতানা সদস্য সচিব, বড় ভাই আবু ইউসুফকে উপদেষ্টা রাখা হয়েছে। আপন ভাইপো চিকিৎসক শফিউল করিম ইলিয়াসকে ভাইস চেয়ারম্যান, এলাকার সমাজসেবী আবুল হোসেনকে অর্থ সচিব, আনোয়ার হোসেনকে সমাজ সেবা সচিব, মুশারত হোসেনকে সহকারী সদস্য সচিব এবং আরিফ মাঈনুদ্দিন ও মিনহাজ উদ্দিনকে সদস্য করা হয়েছে।
এ চিকিৎসালয়ের দায়িত্বরত কর্মকর্তা আবুল হোসেন ও আনোয়ার হোসেন জানান, বর্তমান সময়ের ব্যয়বহুল চিকিৎসা ব্যবস্থার মাঝে এমন একটি দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র বড়ই সহায়ক ভূমিকা রাখবে। তারা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ভবিষ্যতে এই সেবার পরিধি আরো বিস্তৃত করা হবে এবং আরো বেশি সংখ্যক রোগী যেন উপকৃত হতে পারেন সেই লক্ষ্যে কাজ চলছে।
চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী মেডিসিন বিশেষজ্ঞ মো. বেলাল উদ্দিন বলেন, ‘কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সপ্তাহের প্রতি সোমবার দুপুর দুইটা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ প্রদান করা হয় রোগীদের। প্রতিবারই কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ জন রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। এই সেবা কার্যক্রম নিয়মিত চালু থাকলে বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী উপকৃত হবে।’
চিকিৎসালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান ফয়সল মুহাম্মদ ইউনুস বলেন, ‘চাহিদার প্রেক্ষিতে চিকিৎসা কার্যক্রম বর্ধিত করার পাশাপাশি ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত দাতব্য চিকিৎসালয় করার পরিকল্পনা রয়েছে। আমার অবর্তমানেও যাতে এই চিকিৎসালয়ের কার্যক্রম চলমান থাকে সে চেষ্টা আমি সাধ্যমত করে যাব।’
সাতকানিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ইব্রাহিম চৌধুরী বলেন, ‘নিজের কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপনের মাধ্যমে গরিব-দুঃখীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ প্রদানের নজির খুবই হাতেগোনা। এভাবে সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এগিয়ে আসলে অসহায় মানুষ খুবই উপকৃত হবে।’