রাজধানীতে অভিনব কায়দায় প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে “আমেরিকান ওয়েলনেস সেন্টার” নামক একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চটকদার বিজ্ঞাপন এবং ইউটিউব এবং ফেইসবুকে কনসালটেশন কন্টেন্ট তৈরির মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করার অভিযোগও পাওয়া গিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।

প্রায় পঞ্চাশের অধিক অভিযোগ এবং অগণিত ভুক্তভোগী সেবাপ্রার্থীর অভিযোগের ভিত্তিতে জানা গিয়েছে, রাজধানী ধানমন্ডির শুক্রাবাদে অল্টারনেটিভ মেডিসিন এবং ফাংশনাল মেডিসিন থেরাপি পদ্ধতির নাম করে, অনুমোদনহীন এবং প্রচলিত চিকিৎসা শাস্ত্রের নীতিমালা বহির্ভূত পদ্ধতিতে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে “আমেরিকান ওয়েলনেস সেন্টার” নামক একটি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। বার্তা বাজারের অনুসন্ধানী তথ্যের সূত্রধরে জানা যায়, মানুষের স্পর্শকাতর অঙ্গ এবং গোপন রোগের মহৌষধ আবিষ্কারের চটকদার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে, সুসজ্জিত হাসপাতাল সর্বস্ব আসবাব সাজিয়ে নিয়ে প্রতারণার এই অভিনব ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে “আমেরিকান ওয়েলনেস সেন্টার” এমনটাই অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

স্টিম সেল থেরাপির নামে, প্রতি ডোজ পাঁচ লক্ষ টাকা সমমূল্যের ইনজেকশন, ক্ষেত্রভেদে ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদি কোর্সে মাত্র ১০ থেকে ১৫টি ইনজেকশন থেরাপি তথা স্টিম সেল থেরাপি নিলেই, মুক্তি মিলবে জানা অজানা রোগ, বার্ধক্য, দুশ্চিন্তা, ওজন বেড়ে যাওয়াসহ ক্যান্সারের মতো ভয়ানক সব জটিল ব্যাধি থেকে। একই সাথে প্রাণশক্তিতে ভরপুর ও উদ্দ্যোমি হয়ে উঠবে যে কোন বয়সী নারী কিংবা পুরুষ। তবে সম্পূর্ণ কোর্স সম্পন্ন করে একজন রোগীকে থেরাপি নেয়ার জন্য সর্বমোট সম্ভাব্য ব্যয় করতে হবে ৫০ থেকে ৭৫ লক্ষ টাকা। এই বক্তব্যটি মূলত স্টিম সেল প্রতারণার বিজ্ঞাপন। যার ফাঁদ গড়িয়েছে সাধারণ ভুক্তভোগী মানুষ থেকে সরকারের উচ্চপদস্থ এমনকি উপদেষ্টাদের মধ্যে থাকা গুরুত্বপূর্ণ কর্তাব্যক্তিদের কাঁধ পর্যন্ত।

ইতঃপূর্বের বেশ কিছু নথি ঘেঁটে জানা যায় গত বছর ২০২৪ সালের মে মাসে বিতর্কিত ভাবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে নিষেধাজ্ঞার স্বীকার হয়েছিলো প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে জনস্বাস্থ্য অধিদফতরের এবং ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মতো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর। এতো কিছুর পরও, একটি ভুয়া স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান, যেখানে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয় এবং স্টিম সেল থেরাপির নামে ইনজেকশন দিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে, তাদের প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম কীভাবে চলছে সেটি জানতে চেয়েছেন দেশের একাধিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এবং প্রখ্যাত চিকিৎসকরা।

অনুসন্ধানী সুত্রের বরাতে প্রতিষ্ঠানটির ভিজিটিং কনসালটেন্টদের বরাত দিয়ে জানা গিয়েছে, স্টিম সেল থেরাপিতে ব্যবহৃত কোনো ইনজেকশন বাংলাদেশে উৎপাদিত হয় না। শুধু আমেরিকাতে গবেষণার উদ্দেশ্যে তৈরি হওয়া ইনজেকশনটি, নির্দিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানের রিসার্চ ইউনিট সদস্যদের মাধ্যমে অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে লাগেজে করে আমদানি করা হয়। এবং চাহিদাপত্রের বিপরীতে স্বল্প সংখ্যক ইনজেকশন ভাইল প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরবরাহ ও স্টিম সেল নিতে আগ্রহী রোগিদের উপর প্রয়োগ করা হয়।

বিশদ তথ্য অনুসন্ধানে বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান “আমেরিকান ওয়েলনেস সেন্টারের” কর্ণধার এবং অভিযুক্ত প্রসেফর ড. এম মজিবুল হক সম্পর্কে জানা গিয়েছে, সামাজিক মাধ্যম তথা ইউটিউব এবং ফেইসবুকে তিনি একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। লক্ষ লক্ষ ফেইসবুক ইউটিউব ফলোয়ারের সাইবার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে, বর্তমান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দ্বায়িত্বে থাকা পদস্থ কর্মকর্তাসহ বর্তমান সরকারের উপদেষ্টার মধ্যে একাধিক ব্যক্তিকে তার প্রতারণার ফাঁদে ফেলেছেন এমন ভয়ানক অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নির্ভরযোগ্য তথ্যের বরাতে জানা গিয়েছে বিশেষ প্রটোকলে এয়ারপোর্ট থেকে তাকে গ্রহণ করা, এয়ারপোর্টের নিয়ম অনুযায়ী কাস্টমস যাচাই বাছাই ছাড়াই গ্রিন চ্যানেল অতিক্রম করিয়ে দেয়ার মতো সুযোগ দেয়া হয়, অভিযুক্ত প্রফেসর ড. মজিবুর হককে। যে সুবিধার মাধ্যমে লাগেজের ভেতর সুকৌশলে বহন করে দেশে আনা হয় অবৈধ এসব স্টিম সেল ইনজেকশন এমনটাই জানিয়েছেন সূত্রটি। সেই সাথে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্লিনিকের একাধিক সাবেক কনসালটেন্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অল্টারনেটিভ মেডিসিন বা ন্যাচারাল মেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসার কথা বলে রোগীদের সঙ্গে সখ্যতা তৈরি করে, বিকল্প চিকিৎসার আড়ালে ব্যয় বহুল এই স্টিম সেল ইনজেকশনটি সেবা প্রত্যাশীর শরীরে প্রয়োগ করেন। অতঃপর কাঙ্খীত সুফল না পেয়ে, তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে বিভিন্ন ভাবে এড়িয়ে যান ন্যাচারাল মেডিসিন প্রক্রিয়া থেকে। দামি দামি ফুড সাপ্লিমেন্ট এবং স্টিম সেল থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করানোর পর, কাঙ্খীত সেবা না পাওয়া একাধিক সেবাপ্রার্থীর বরাত দিয়ে জানা গিয়েছে, নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ লোপাটের পর প্রতারণার আশ্রয় নেন তার প্রতিষ্ঠানের সবাই। যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া এমনকি মুঠোফোনে ব্লক করে দেয়ার অভিযোগও এনেছেন একাধিক ভুক্তভোগী।

 

কে এই প্রফেসর ড. মজিবুল হক?

সামাজিক মাধ্যমে থাকা উপাত্ত এবং সুনির্দিষ্ট তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত ন্যাচারাল ইন্টিগ্রেটিভ এবং ফাংশনাল মেডিসিনের উপর বিশেষজ্ঞ এবং টেক্সাসে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব ইন্টিগ্রেটেড হেলথের তিনি একজন সম্মানিত অধ্যাপক। এছাড়াও আমেরিকান ওয়েলনেস সেন্টারের তিনি একজন গবেষণা সদস্য। পাশাপাশি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত আমেরিকান ওয়েলনেস সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাও তিনি।

যদিও সামাজিক মাধ্যমে থাকা কিছু ভিডিও বার্তার মারফত অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে প্রফেসর ড. মজিবুল সম্পর্কে প্রদত্ত এসব তথ্যের বেশিরভাগই ভুয়া বানোয়াট এবং জালিয়াতির মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত। প্রফেসর ড. মজিবুল হকের বিষয় নিয়ে নির্দিষ্ট তথ্য ও প্রমান সহযোগে অভিযোগ তুলেছেন এমন বেশ কয়েকজনের তথ্যের বরাত দিয়ে জানা গিয়েছে, নিজেকে প্রফেসর দাবী করতে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম তিনি উল্ল্যেখ করে থাকেন, এমন কোন প্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব টেক্সাস তথা গোটা আমেরিকার কোথাও নেই। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানা অনুসন্ধান করে সেখানে একটি রেস্তরা এবং ফিটনেস সেন্টার খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। এছাড়াও আমেরিকান ওয়েলনেস সেন্টার নামক যে প্রতিষ্ঠানটির পরিচয় তিনি বহন করছেন, আদতে এমন কোন নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব এবং প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে তার বৈধ কোন যোগসূত্র নেই যেটি নিশ্চিত করেছেন খোদ আমেরিকান স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ এন্ড হিউম্যান সার্ভিস (এইচ.এইচ.এস)।

অত্যান্ত পরিশীলিত যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত আমেরিকান ওয়েলনেস সেন্টার এবং সেখানে বিদ্যমান স্টিম সেল সেবা মূলত কি জানতে অভিযুক্ত প্রফেসর  ড. মুজিবুল হকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, এটি একটি ন্যাচারাল চিকিৎসা পদ্ধতি। যা ধীরে ধীরে প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিকে ছাপিয়ে সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এছাড়াও তার তত্ত্বাবধায়নে আমেরিকায় প্রায় অর্ধশতাধিক কনসালটেন্ট এর একটি টিম এটি নিয়ে নিয়মিত গবেষণা করছেন এবং প্রচুর পরিমানে মার্কিন এবং নন-মার্কিন নাগরিকরা এতে অভ্যস্ত হচ্ছেন উপকৃত হচ্ছেন। এছাড়াও ন্যাচারল মেডিসিন এবং ক্লিনিক্যালোপ্যাথির তিনি একজন সর্বজনবিদিত গবেষক।

মুঠোফোনালাপের দীর্ঘ বর্ণনায় তিনি আরো উল্ল্যেখ করেন, বাংলাদেশের খ্যাতনামা চিকিৎসাবিদ, পত্রিকার সম্পাদক, সাংবাদিকসহ নাগরীক সমাজের অগণিত মানুষকে নিয়ে, ঢাকার অভিজাত পাঁচ তারকা হোটেলে তিনি একাধিক সেমিনার এবং সচেতনতা সভা করেছেন। যদিও তার প্রতিষ্ঠিত ক্লিনিকগুলোকে কেন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তিনি ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিস করছেন কি না জানতে চাইলে তিনি জানান, দেশের প্রচলিত নিয়ম মেনেই তার প্রতিষ্ঠান চলছে। তবে বক্তব্যের বিপরীতে তিনি কোন কাগজ প্রদর্শন কিংবা অনুমোদনকারী যথাযথ কর্তৃপক্ষের নাম জানাতে পারেন নি। এছাড়াও তার অর্জনকৃত বিশেষ অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে কোন মন্তব্য করেন নি। উপরন্তু তিনি বারবার বর্তমান সরকারের ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তার সখ্যতা এবং দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে তার ঘনীষ্ঠতার বিষয়টি উল্ল্যেখ করেছেন।

লাগেজ ক্যারিয়ারে ইনজেকশন এনে রোগীদের শরীরে প্রয়োগ করার যথাযথ বৈধতা দেশের প্রচলিত চিকিৎসা নীতিমালায় আছে কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানা গিয়েছে, এটি সম্পূর্ণ বেআইনি প্রক্রিয়া। চিকিৎসার প্রয়োজনে কোন ঔষধ অথবা ইনজেকশন আমদানি করার যে বৈধ প্রক্রিয়া, তার ধারে কাছেও নেই স্টিম সেল থেরাপির এই ইনজেকশন ভাইল। মানব শরীরে প্রয়োগের জন্য একটি ঔষধের রাসায়নিক গুণাগুন এবং তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত সব বিষয়ের আর্টিকেল এবং রিসার্চ পেপারসহ, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের যে সব ছাড়পত্র, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে নিতে হয়, তার কোনোটারই অস্তিত্ব নেই, কথিত এসব স্টিম সেল ইনজেকশনের। বরং কোনরূপ জানা শোনা বাদে, দেশের চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী রেজিস্টার্ড পরামর্শক কিংবা দেশের বাহিরের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত চিকিৎসক এবং পরামর্শকদের জ্ঞাত বহির্ভূত কোন চিকিৎসা নিতেও নিবৃত করেন সরকারি এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।

এছাড়াও তিনি বলেন, ড্রাগ কন্ট্রোল অর্ডিন্যান্স ১৯৮২ এর ২০২৩ সালের সংশোধিত ২৯ নম্বর আইনের ৩৬ ধারার সংজ্ঞায়িত আদর্শ মান বলতে যা বোঝানো হয়েছে, তার কোন একটি মানদণ্ডের সঙ্গে এটি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে এরূপ চিকিৎসা ব্যবস্থা পরিচালনা করা, বিজ্ঞাপন দেয়া, অনুমোদন বিহীন ঔষধ আমদানি, সংরক্ষণ এবং প্রয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে এগারো অনুচ্ছেদের ৫৪ থেকে ৫৭ ধারা মোতাবেক ফৌজদারি আইনে অভিযোগ গঠন করে তদন্ত এবং অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার অভিপ্রায় ব্যক্ত তিনি।

দেশের প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থার আড়ালে ভয়াবহ রকম প্রতারণা চলছে, এ বিষয়ে মাননীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন অসংখ্য ভুক্তভোগীসহ প্রতারণার স্বীকার একাধিক সেবা প্রত্যাশী। তাদের প্রত্যাশা সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।