বাংলাদেশ ভূখণ্ডের পদ্মা ও যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত পাবনা জেলার আমিনপুর থানার অবস্থান। কাজির হাট ফেরিঘাট হতে মাত্র কোয়াটার কিলো দূরে মহাসড়কের পাশে খাস জায়গায় বসবাস করতেন রহিমা খাতুন (ছদ্মনাম) তার তিন সন্তান ও স্বামী মিস্টার করিম (ছদ্মনাম)।

দীর্ঘ ১০ বছর বিবাহিত জীবনে তাদের সম্পর্ক ছিল টক মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রণ।  কখনো সংসারে অশান্তি ঝগড়া বিবাদ কখনো ভালোবাসা। এরমধ্যেই পরপর জন্ম নেয় তিন তিনটি সন্তান। রহিমা খাতুন ছিলেন অত্যন্ত হিসাবী সংসারের যাবতীয় হিসাব নিকাশ রহিমা খাতুন নিজেই রাখতেন এবং সন্তানদের মানুষ করার জন্য  টাকাপয়সা সঞ্চয় করে রাখার  চেষ্টা করতেন। রহিমা খাতুন নিজেই বিভিন্ন সময়ে রাস্তার মাটি কেটে বিভিন্ন মেসে রান্না করে দেওয়ার বিনিময়ে টাকা পয়সা আয় করতেন। পক্ষান্তরে তার স্বামী  মিস্টার করিম ছিলেন অলস  মাঝেমধ্যে জুয়া  খেলায় অংশগ্রহণ সহ গাঁজা সেবন করতেন এবং টাকা পয়সা সঞ্চয় করে রাখা  তিনি বুঝতেন না।

এ নিয়ে প্রায়ই তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে  ঝগড়া-বিবাদ হতো। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিয়মিত বিবাদে  স্ত্রীকে হত্যা করার  পরিকল্পনা করেন  প্রায় তিন মাস আগে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ওষুধের দোকান হতে ঘুমের ঔষধ কিনে বাড়িতে রাখেন। কেউ যেন হত্যার পরিকল্পনা বুঝতে না পারে সেজন্য তিনি তার স্ত্রী ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে ভাল আচরণ করতেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ০৪/০৭/২২ইং তারিখ সপরিবারে রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষে  সন্তানদের নিয়ে  মিস্টার করিম ও রহিমা দম্পতি ঘুমাতে যায়। ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ মিস্টার করিম  তার স্ত্রীকে কোমল পানীয়র মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে তার স্ত্রীকে সেবন করায়। স্ত্রী-সন্তান সবাই  যখন ঘুমে বিভোর তখন কিলিং মিশনে নামে নর ঘাতক স্বামী মিস্টার করিম। ঘুমন্ত অবস্থায় প্রথমে রহিমার হাত ও পা  গরুর রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে  এবং গামছা দিয়ে গলা পেচিয়ে দীর্ঘসময় রেখে মৃত্যু নিশ্চিত করে। ঘটনাটি ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য তার স্ত্রীর মৃতদেহটি বাড়ির পাশে ডোবায় ফেলে দেয় এবং মৃতদেহটি যেন পানির উপরে ভেসে না ওঠে  সেজন্য বাড়িতে থাকা ধারালো চাকু দিয়ে তার স্ত্রীর পেট  চিরে নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলে। কিলিং মিশন শেষে নর ঘাতক স্বামী সকাল হওয়ার অপেক্ষায় থাকে। সকালের সূর্য উদয় হলে  প্রতিবেশী ও নিকটাত্মীয়দের জানায় যে, রাত থেকে  তার স্ত্রী  কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রহিমার আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীরা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন।

খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে মিস্টার করিমের বাড়ির পাশে একটি মৃতদেহ দেখতে পেয়ে আমিনপুর থানা পুলিশকে খবর দেয়। আমিনপুর থানা পুলিশ স্থানীয় লোকজনের সহায়তায়  মৃতদেহটি উপরে উঠায় । পুলিশের উপস্থিতিতে  নিজ স্ত্রীকে হত্যাকারী মিস্টার করিম আহাজারি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে  স্থানীয় লোকজনও মিস্টার করিমের ব্যথায় ব্যথিত হয়। প্রাথমিকভাবে দেখে বোঝার উপায় নেই  যে মিস্টার করিমই তার স্ত্রীর হত্যাকারী।  রহিমার ভাই বোন আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশী কেউ বিশ্বাস করে না যে রহিমাকে কেউ খুন করতে পারে। তাৎক্ষণিক ভাবে মিস্টার করিম কে প্রাথমিকভাবে তদন্তের স্বার্থে হেফাজতে নিলে উৎসুক জনতা পুলিশের উপর ক্ষিপ্ত হতে পারে। একদিকে উৎসুক জনতা  অন্যদিকে রহস্য ঘেরা মৃতদেহ নিয়ে মুহূর্তেই পুলিশের নাওয়া-খাওয়া-ঘুম যেন হারাম হয়ে গেল। সহকারী পুলিশ সুপার জনাব রবিউল ইসলাম সুজানগর সার্কেল, অফিসার ইনচার্জ আমিনপুর থানা জনাব রওশন আলী, পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) জনাব এমরান মাহমুদ তুহিন,  আমিনপুর জোন ডিএসবি  ডিআইও জনাব রেজাউল করিম সহ আমিনপুর থানার অন্যান্য অফিসারবৃন্দ  তথ্য সংগ্রহ তথ্য বিশ্লেষণ  শুরু করে। কিন্তু চারদিকেই শুধুই ধোঁয়াশা। সকল অফিসারের মাথার ঘাম  ঝরতে শুরু করে।

সকল অফিসার  নিজ নিজ কর্মজীবনের  অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সামনে এগুতে থাকে।  সকল তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ শেষে  মিস্টার করিম কে সুকৌশলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেওয়া হয়। মিস্টার করিমের কথাবার্তায় অসঙ্গতি দেখে  পুলিশের সন্দেহ বেড়ে যায়। করিম বারবার তদন্ত ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যায়। চলে পুলিশ বনাম করিম কথার খেলা, যুক্তির খেলা, যুক্তি খন্ডন -পাল্টা যুক্তি। কিন্তু থানায় জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে পুলিশের সংগে যুক্তির খেলায় ব্যর্থ হয়ে সে সবকিছু শিকার করে যে সে নিজেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পুলিশ তাকে পূনরায় ঘটনাস্থলে নিয়ে যায় তখন উপস্থিত জনতার সামনে কিলিং মিশনে ব্যবহৃত  ঘুমের ঔষধ মেশানো এনার্জি ড্রিংকসের প্লাস্টিকের বোতল, হাত পা বাধার দড়ি,হত্যায় ব্যবহৃত গামছা ও পেট কেটে দেওয়ায় ব্যবহৃত ধারালো চাকু বাহির করে দিয়ে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়। বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪  ধারায় স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি প্রদান করে। উক্ত বিষয়ে আমিনপুর থানায় একটি হত্যা মামলা রুজু হয়। সেই সাথে শেষ হয়ে যায় একটি পরিবারের স্বপ্ন ও তিনটি নাবালক শিশুর  জীবন।

মায়ের অকাল মৃত্যু, পিতার ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাওয়া  কোনো কিছুই যেন তাদেরকে ভাবিয়ে তুলছে না। পৃথিবীর কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই  তাদের সব কিছু যেন শেষ হয়ে গেল।  তাই দেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছে অনুরোধ থাকবে  যে কোন অপরাধ সংগঠনের পূর্বে অন্তত ভাবুন নতুন প্রজন্ম আপনাকে ক্ষমা করবে কিনা। অপরাধী যতই পরিকল্পিতভাবে অপরাধ সংঘটিত করুক তদন্তে তা বেড়িয়ে আসবেই। কারণ পারফেক্ট ক্রাইম বলে কোনো ক্রাইম নাই।