বসুন্ধরা গ্রুপ এবং গ্রুপের মিডিয়াকে চাপে রাখতে নোংরা খেলায় মেতেছিল বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার।

মোসারাত জাহান মুনিয়ার মৃত্যুতে জড়িত মূল আসামিকে রক্ষা করতেই অভিযুক্ত করা হয় বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরকে। এরপরই শুরু হয় তাদের আসল খেলা। বসুন্ধরা গ্রুপের কাছে ১০০ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। চাঁদা না দিলে মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনার পুরো দায় বসুন্ধরা গ্রুপের ওপর চাপানো হবে বলে তারা হুমকি দিতে থাকে। কিন্তু বসুন্ধরা গ্রুপ কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবে না বলে জানিয়ে দেয়। এমন ঘোষণার পর মুনিয়ার মৃত্যু নিয়ে শুরু হয় নাটক। আর এ নাটকের অন্যতম কারিগর হলেন গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক প্রধান হারুন অর রশিদ, যাকে কনটেন্ট ক্রিয়েটর  তৌহিদ আফ্রিদি ‘হারুন চাচা’ বলে ডাকতেন। আর তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এই তিনজনকেই নিয়মিত নারী সরবরাহ করতেন তৌহিদ আফ্রিদি। এ কারণে আফ্রিদিকে রক্ষা করতে মুনিয়ার মৃত্যুর পুরো ঘটনাটি চাপিয়ে দেওয়া হয় বসুন্ধরা গ্রুপের ওপর।

তৌহিদ আফ্রিদিকে গ্রেপ্তারের পর এমন চাঞ্চল্যকর সব তথ্য ফাঁস হতে শুরু করেছে। সিআইডির জেরার মুখে গুরুত্বপূর্ণ নানা তথ্য দিচ্ছেন তৌহিদ আফ্রিদি। সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, তৌহিদের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ তাদের কাছে রয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে তৌহিদ আফ্রিদির বাসায় অভিযান চালিয়ে সিআইডির একটি টিম মোবাইল ফোন, কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক এবং ল্যাপটপ জব্দ করেছে। তৌহিদ আফ্রিদির ব্যবহৃত এসব কম্পিউটার ও বিভিন্ন ডিভাইস ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হবে পরীক্ষার জন্য।

সূত্র জানায়, মুনিয়ার সঙ্গে তৌহিদ আফ্রিদির সম্পর্কের বিষয়টি গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন। তাদের সম্পর্কটা শুরু হয় স্ট্রিম কার নামে একটি অ্যাপসের মাধ্যমে। যেই অ্যাপসে অনলাইন জুয়া থেকে শুরু করে ডেটিং এবং মাদক বিকিকিনি হয়ে থাকে। এ অ্যাপসের মাধ্যমে নতুন নতুন মডেল নায়িকাদের নেটওয়ার্ক তৈরি করত। এ নেটওয়ার্কের সদস্যদেরই আফ্রিদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে সরবরাহ করত। মাদক আর নারী সাপ্লাই ছিল তার ক্ষমতার উৎস।

 

কামাল ও হারুনের প্রশ্রয়েই বেপরোয়া আফ্রিদি

নিজের ‘গুডবয়’ মার্কা চেহারার আড়ালে সত্যিকারের ‘ব্যাডবয়’ তৌহিদ আফ্রিদি এই জাদুর শহর ঢাকার রোমিও। অসংখ্য জুলিয়েটকে রাতের রঙিন আলোয় নাচিয়ে নিজে রোমাঞ্চে বুঁদ হয়ে দিনের বেলায় নিষ্পাপ কনটেন্ট ক্রিয়েটর। বাবা টিভি চ্যানেলের দখলদার মালিক। তাঁকে ক্ষমতার ‘পাওয়ার হাউস’ বানিয়ে সব অপকর্মের ‘ফুয়েল’ নিয়েছেন হাসিনার মন্ত্রী আনিসুল-কামালের কাছ থেকে। মিথ্যা প্রেম-প্রতারণা, ব্ল্যাকমেইল, দখল, মদ-মাস্তি-নির্যাতনের মতো যত অপরাধ আছে, এসবের লাইসেন্স দিয়ে পাশে থেকেছেন ডিবি হারুন। বিনিময়ে ‘ট্র্যাপে’ ফালানো অসংখ্য সুন্দরী তরুণীকে দিয়ে তাঁদের মনোরঞ্জন। মাফিয়া হয়ে অহরহ এসব অপকর্মই ঘটিয়েছেন ধরা পড়া কনটেন্ট ক্রিয়েটর তৌহিদ আফ্রিদি।

আলোচিত মুনিয়া হত্যায় অভিযোগের তির এখন তাকে ঘিরে। যে মামলায় মিথ্যা অভিযোগে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরকেও জড়ানো হয়েছিল। জুলাই আন্দোলনে এক হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারের পর মুখোশের আড়ালে তার অপরাধ জগতের আসল রহস্য উন্মোচিত হতে শুরু করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুক্তভোগীরা এখন তার অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরছেন। সিআইডি বিষয়টি তদন্ত করছে।

জানা যায়, বেসরকারি টিভি চ্যানেল মাইটিভির চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন সাথীর ছেলে কনটেন্ট ক্রিয়েটর তৌহিদ আফ্রিদি ছিলেন সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের মধ্যমণি। অবৈধ ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তিনি অর্ধশতাধিক তরুণীকে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজে বাধ্য করান বলে অভিযোগ রয়েছে। তার অন্ধকার জগতের নেপথ্যের শক্তি ছিলেন অনেক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও সাবেক আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা।  এভাবে তার নারী কেলেঙ্কারিসহ প্রভাবশালীদের সঙ্গে নানান অনৈতিক কর্মকাণ্ডের তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

 

ফিরে দেখা মুনিয়ার ঘটনাপ্রবাহ

২০২১ সালের রমজান মাস। ইফতারির এক ঘণ্টা আগে মুনিয়া ও তাঁর বোনের ফোনালাপ (ইফতারির পর দুই বোন শপিং করবেন)। কিন্তু বড় বোন এসে দেখেন মুনিয়া আত্মহত্যা করেছেন। ঝুলন্ত শরীর নিচে নামিয়ে এক ঘণ্টার মাধ্যেই এটাকে হত্যা মামলায় রূপান্তর করে মামলা দায়ের (রাত্র ৮টা বা সাড়ে ৮টার দিকে), পরদিন সকালেই আদালতের নির্দেশ এ মামলার আসামিরা বিদেশে যেতে পারবেন না। বিদ্যুৎগতিতে চলে কার্য সম্পাদন। আর সেই মামলায় বসুন্ধরার এমডিকে ফাঁসানোর নীলনকশা করেন কামাল-হারুন-আফ্রিদি গং। এমন কোনো নিকৃষ্ট কাজ নেই তাঁরা অর্থের বিনিময়ে করেননি। প্রথমে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে মানুষকে ফাঁসানোর চুক্তি করেন, আবার ফাঁসানোর পরে চুক্তি করে বাঁচানোর যদি সুযোগ পান তাঁরা এ চেষ্টা করেন। ফ্যাসিবাদের প্রশাসন ও তাদের এজেন্টরা অর্থের জন্য এমন কোনো নিকৃষ্ট কাজ নেই যা করেনি। তার অন্যতম উদাহরণ মুনিয়া হত্যা মামলায় বসুন্ধরা এমডিসহ অন্যদের জড়ানো। অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই সায়েম সোবহানকে মিডিয়া ট্রায়ালের মুখোমুখি করা হয়। ঘটনার পর মুনিয়ার চ্যাটের কয়েকটি স্ক্রিনশট সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এসব স্ক্রিনশটের মধ্যে বিভিন্নজনকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা দাবি করার কিছু স্ক্রিনশটও সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এ ছাড়া মামলার বাদী নুসরাত ও তাঁর বোন মুনিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তির চ্যাট ও ফোন কল রেকর্ড পাওয়া যায়, যা বসুন্ধরা গ্রুপের বিরুদ্ধে বড় ধরনের ষড়যন্ত্রের মূল প্রমাণ। তবে সব জল্পনা শেষে বিতর্কিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর তৌহিদ আফ্রিদির মুনিয়া হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার আভাস মিলেছে এত দিন পরে এসে এক অডিও কল রেকর্ড ফাঁস হওয়ার পর।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া তৌহিদ আফ্রিদির নারী ঘটিত নিষ্ঠুরতা প্রমাণের অডিও ভাইরাল হওয়ার পর মুনিয়ার মৃত্যুর পেছনে আফ্রিদির জড়িত থাকার বিষয়টি অনেকটাই নিশ্চিত। সূত্র মতে, ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল মুনিয়ার লাশ উদ্ধারের পরপরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা ছিল সন্দেহজনক। দ্রুততম সময়ের মধ্যে মুনিয়ার মৃত্যুর মামলা দায়ের এবং পরবর্তী ১৪ ঘণ্টায় এ বিষয়ে আদালতের নির্দেশ প্রশ্নের সৃষ্টি করেছিল। হারুন-কামাল-আনিস গংয়ের তৎপরতায় এসব দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হয়। তৎকালীন গুলশান বিভাগের ডিসি সুদীপ কুমার ফরমায়েশি এ মামলাটি নিজে উপস্থিত থেকে দায়ের করান। এর কিছুদিন পরই তাকে পুরস্কার হিসেবে বগুড়ার এসপি করা হয়।

২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল রাজধানীর গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে মুনিয়ার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই রাতেই তার বোন নুসরাত জাহান গুলশান থানায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে মামলা করেন। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে করা এ মামলার দীর্ঘ তদন্ত শেষে ওই বছরের ১৯ জুলাই ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। পরে গুলশান থানার ওসি আবুল হোসেনের দাখিল প্রতিবেদনের ওপর শুনানি হয়। শুনানি শেষে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম রাজেশ চৌধুরী সায়েম সোবহান আনভীরকে মামলার সঙ্গে জড়িত থাকার কোনো যৌক্তিক কারণ না থাকায় তাকে মুক্তি দেন। সেই সঙ্গে বাদী নুসরাতের করা পুলিশি প্রতিবেদন যৌক্তিক না হওয়ায় আপিল খারিজ করে দেন আদালত।

আত্মহত্যায় প্ররোচনার প্রথম মামলাটি খারিজ হলে নুসরাত বাদী হয়ে মুনিয়াকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে আরেকটি ষড়যন্ত্রমূলক মামলা করেন। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এ আটজনের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়। এরপর আদালত গুলশান থানায় মামলাটি জবানবন্দি রেকর্ড করার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয় পিবিআইকে।

মামলায় বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরসহ বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, তাঁর স্ত্রী আফরোজা সোবহান ও সায়েমের স্ত্রী সাবরিনাকে আসামি করা হয়েছে। অন্য আসামিরা হলেন- সাইফা রহমান, ফারিয়া মাহবুব, শারমিন ও ইব্রাহিম আহমেদ। পরে এ মামলায় সাইফা ও ফারিয়াকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। অবশেষে প্রায় এক বছর দীর্ঘ তদন্ত শেষে আসামিদের মুক্তির সুপারিশ করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পিবিআই। এ ছাড়াও মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে পিবিআই জানায়, মুনিয়া আত্মহত্যা করেছেন।