পূর্বপুরুষেরা বাঁশের কাজ করতো-এ কারণে বাঁশফোর নামকরণ। নারী-পুরুষ অনেকের নামের শেষে বাঁশফোর পদবীটি ব্যবহার করে। বাংলাদেশে এরা হরিজন নামে পরিচিত। তবে স্থানীয়ভাবে সুইপার বা মেথর হিসেবে পরিচিত। একটি নির্দিষ্ট স্থানে সমাজবদ্ধভাবে এরা বসবাস করে থাকে। এদের প্রধান পেশা ঝাড়–দার এবং পয়ঃনিষ্কাসন। হাসপাতালে এরা ডোমের কাজও করে থাকে। বৃটিশ সরকার বাংলাদেশে এদেরকে নিয়ে আসে ঝাড়–দার-ক্লিনার-সুইপার হিসেবে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় নগর সভ্যতার ক্রমবিকাশের কারণে শিল্প-বাণিজ্য এবং রেলযোগাযোগের প্রসার ঘটে। আবার নগরকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং নগরবাসীকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য সৃষ্টি হয় পৌরসভা। নগর-বন্দর, শিল্প-বাণিজ্য ও রেলওয়ে ইত্যাদি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ হতে এদেরকে এদেশে নিয়ে আসা হয় এবং সুইপার-ক্লিনার-পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এদের বর্তমান মাসিক আয় ৩০০০ টাকা থেকে ১২০০০ টাকা পর্যন্ত। এপেশায় বাঁশফোর নারীরাও কাজ করে থাকে।
প্রথমদিকে চাকরির পাশাপাশি থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে বৃটিশ সরকার। থাকার জন্য এদের অবস্থান হয় নগরের শেষপ্রান্তে একটি নির্দিষ্ট স্থানে। এদের দিনের বেলা বাহিরে বের হওয়া ছিল নিষিদ্ধ। রাতের অন্ধকারে সমস্তপ্রকার কাজ শেষ করতে হতো। এদের নিজস্ব কোন জায়গা-জমি বা বাড়ি-ঘর নেই। সকলেই ভূমিহীন। এখনও পৌরসভা-সিটিকরপোরেশন বা সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দকৃত কলোনিতে এদের বসবাস। বাঁশফোর সম্প্রদায় সনাতন ধর্মাবলম্বী। এদের ধর্মীয় উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম ছট পূজা, হোলি, শিতলা পূজা, জিউতীয়া পূজা, লক্ষী পূজা, সরস্বতী পূজা, ঘরোয়া পূজা, দূর্গা পূজা, কালি পূজা ইত্যাদি।
বাঁশফোরদের মাতৃভাষা ভজপুরী এবং এদের দ্বিতীয়ভাষা বাংলা। সাধারণত নিজেদের মধ্যে ভোজপুরী ভাষায় কথা বলে। এদের আদি নিবাস ভারতের গোরকপুর ও ছাপড়া জেলায়। পূর্ব পুরুষেরা ধুতি ও পাঞ্জাবি পরতো এবং নারীরা কুচি দিয়ে আঁচল সামনে রেখে শাড়ি পরতো। বর্তমানে পুরুষেরা লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, জিন্স প্যান্ট, শার্ট, গেঞ্জিসহ আধুনিক ধাচের সবধরনের পোষাক পরতে দেখা যায়। নারীদের মধ্যেও বাঙালি নারীদের মতো থ্রিপিচ, সালোয়ার কামিজ, ম্যাকসি ইত্যাদির পাশাপাশি কুচি দিয়ে আঁচল সামনে রেখে শাড়ি পরিধান করে থাকে। নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে উঁলকি আঁকতে দেখা যায়।
বাঁশফোর সমাজ পঞ্চায়েত দ্বারা পরিচালিত হয়। পঞ্চায়েত প্রধানকে চৌধুরী বলা হয়। এই পঞ্চায়েত বিচার-সালিশসহ সামাজিক অনুষ্ঠান বিশেষ করে বিয়ে, মৃত্যু ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনে অনুমতি প্রদান করে থাকে। পঞ্চায়েতের অনুমতি ছাড়া বিয়ে, মৃত্যু ইত্যাদি কেউ পালন করতে পারে না। পঞ্চায়েতে কোন নারী সদস্য থাকে না। পূর্বে পঞ্চায়েত প্রধান হতো সমাজে যার প্রভাব আছে তিনি এবং তা বংশপরম্পরায় চলতো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে অত্র অঞ্চলে ভোটের মাধ্যমে পঞ্চায়েত গঠিত হচ্ছে। সমাজে কেউ অপরাধ করলে পঞ্চায়েত সেই ব্যক্তি বা তার পরিবারকে কুজাত (একঘরে), বেত্রাঘাত, জুতারমালা প্রদান, অর্থ জরিমানা, সমাজকে খাওয়ানো ইত্যাদি সাজা প্রদান করে থাকে। কুষ্টিয়া সদর, কুমারখালি, খোকসা, ভেড়ামারায়, মিরপুর, চুয়াডাঙ্গা সদর, দামুড়হুদা, জীবননগর, মেহেরপুর সদর ও গাংনী উপজেলায় এ সম্প্রদায়ের প্রায় ৪০০ টি পরিবারের ২৪০০ লোকের বসবাস।