গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানে পতন ঘটে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ওতার সরকারের। পতনের পর দেশব্যাপী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পদত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়।
এরই ধারাবাহিকতায় পদত্যাগ করেন জাহাঙ্গীরনগরের উপাচার্যসহ সকল প্রশাসনিক কর্মকর্তা। দলীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ায় বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের দাবি থেকে দলকে গুরুত্ব দেয়ার অভিযোগও করেছেন শিক্ষার্থীদের। নতুন উপাচার্যকে নিয়ে তাই শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলছে আলোচনা।গত ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে ছাত্রলীগের বর্বরোচিত হামলা করে।
হামলার পরে শিক্ষার্থীরা তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক নুরুল আলমের বাসভবনে অভিযোগ জানাতে যায়। ১৬ জুলাই ভোরে শিক্ষার্থীদের উপর পুনরায় তার বাসভবনের সামনেই ছাত্রলীগ পেট্রোল বোমা, রামদা ও বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ ওরে। এসময় তিনি বাসায় বসে থাকলেও শিক্ষার্থীদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন নি। এমনকি ১৭ জুলাই শিক্ষার্থীরা হল ভ্যাকেন্টের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে রেজিস্টার ভবনের সামনে অবস্থান নিলে তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক আলমগীর কবিরের মাধ্যমে তারা পুলিশের কাজে নিজেদের জিম্মি দাবি করেন এবং সহায়তা চান। ফলে পুলিশ শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমণ করে। এসকল ঘটনায় আহত হয় প্রায় ৩ শতাধিক শিক্ষার্থী।
এছাড়াও পূর্বের বিভিন্ন সময়ে তার দল কেন্দ্রিকতা, দুর্নীতি ও বিচারহীনতা শিক্ষার্থীদের বার বার রাজপথে ঠেলে দিয়েছে। সর্বশেষ ৭ আগস্ট শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মচারীদের তোপের মুখে তিনি ও তার প্রশাসন পদত্যাগ করে ।শিক্ষার্থীদের দাবি নতুন উপাচার্য হিসেবে যাই আসুক না কেন তাকে অবশ্যই দল-মতের ঊর্ধ্বে কাজ করতে হবে। তার কাছে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলে যেন নিরাপদ থাকে। এমন যেন না হয় তিনি পূর্ববর্তীদের মতোই দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছেন। তাকে শিক্ষক হিসেবে যেমন দক্ষ হতে হবে প্রশাসক হিসেবে একইভাবে দক্ষ হতে হবে। ব্যক্তি বা দলীয় সর্বার্থ রক্ষা না করে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানসম্মত করে গড়ে তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ- প্রকৃতিকে রক্ষা করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হারানো গৌরব পুনরায় ফিরিয়ে আনতে হবে।বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ৫১ ব্যাচের শিক্ষার্থী আমিরুল ইসলাম বলেন, উপাচার্য হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীর অভিভাবক ও প্রশাসনিক প্রধান। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে অবশ্যই আমি এমন একজন সৎ, যোগ্য ও শিক্ষার্থী বান্ধব শিক্ষককে আমরা চাই। যিনি সকল ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবেন। একটি নিরাপদ, সবুজ, পরিষ্কার -পরিচ্ছন্ন, মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত, আধুনিক ক্যাম্পাস আমাদের উপহার দিতে পারবেন এমন একজন দক্ষ, নেতৃত্বগুণ সম্পন্ন শিক্ষককেই আমি উপাচার্য হিসেবে দেখতে চাই।
বিশ্ববিদ্যালয় অভ্যন্তরীণ যেকোনো অন্যায়ের প্রতিকারে সচেষ্ট থাকবেন এবং যেকোনো অন্যায় ঘটনার সঠিক তদন্ত করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসবে। সর্বোপরি কোনো দলের জন্য না বরং তিনি দেশের জন্য কাজ করবেন।বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সকল কিছুর দায় গ্রহণ ও সঠিক বিচার করার আহ্বান জানিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৫১ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সামিহা সালমা বলেন, উপাচার্য হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সকলেই তার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু বিগত সময়ে আমরা উপাচার্য থেকে দায়িত্বশীল কোনো ভূমিকা দেখি নি। যিনি দায়িত্বে আসবেন তিনি যেন দায়িত্ব নেওয়ার সাথে সাথেই তার রাজনৈতিক পরিচয় ভুলে নিরপেক্ষভাবে কাজ করেন। তাকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে কাজ করতে হবে। দলীয় বা ব্যক্তি স্বার্থে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া যাবে না। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তুলতে তাকে সকল কাজ সঠিকভাবে তদারকি করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিক্ষার্থীবান্ধব হতে হবে দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম ও মিডিয়া স্টাডিজ ৫০ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মালিহা নামলাহ বলেন, উপাচার্য হিসেবে এমন একজনকে চাই যার দলীয় পরিচয় নিয়ে কখনো আমাদের সংশয় প্রকাশ করতে না হয়। তাকে অবশ্যই শিক্ষার্থীবান্ধব করতে হতে হবে । বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো ঘটনা ঘটলে সেই সমস্যা সমাধানে তাকে দক্ষ প্রশাসকের ভূমিকা পালন করতে হবে । যাতে করে বিগত উপাচার্যদের মতো দাবি আদায়ে পুনরায় শিক্ষার্থী বারবার মাঠে নামতে না হয়। জাবির প্রাণ-প্রকৃতির সাথে শিক্ষার্থীদের এক গভীর যোগাযোগ রয়েছে ।কাজেই প্রাণপ্রকৃতি রক্ষায় তাকে কাজ করতে হবে এবং পূর্ববর্তী ভুলগুলোর যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে তাই তাকে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নে সচেষ্ট হতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট গণবিপ্লবের পর যখন শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগ করে তখন একের পর এক সকল উপাচার্য, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্কুল কলেজের প্রশাসনও পদত্যাগ করতে থাকে। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনকে কতটা দলীয়করণ করলে সরকার পতনের সাথে সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশাসনিক শূন্যতা সৃষ্টি হয় তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি । ফলে শিক্ষাব্যবস্থায় এক স্থবিরতা নেমে এসেছে। উপাচার্য হিসেবে যেই আসুক না কেন সে যেন কোনো নির্দিষ্ট দলের দ্বারা প্রভাবিত না হয়। তিনি যেন নিজের বা দলের স্বার্থে নিজের শিক্ষার্থীদের উপর গুলি বর্ষণ বা লাঠি চার্জ করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেয়ার মতো গর্হিত কাজ না করেন।
আমরা চাই শিক্ষার্থীবান্ধব দায়িত্বশীল একজন ব্যক্তিকে এই পদে যিনি দলের উপরে গিয়ে নিজ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হবেন । যেহুতু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় সেহুতু তিনি চাইলে সরকারের পরামর্শ নিতে পারেন। কিন্তু এমন যেন না হয় তিনি কোনো দল দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছেন।নতুন বাংলাদেশের উপাচার্যের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, বর্তমানে যারাই দায়িত্বশীল এই পদগুলোতে আসবেন তাদের মনে রাখতে হবে এই বাংলাদেশ গণ-অভ্যুত্থান পরর্বতী বাংলাদেশ। আর এই অভ্যত্থানে জাবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে । কাজেই যিনি উপাচার্য হিসেবে একজন দক্ষ শিক্ষক এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ একজন দক্ষ প্রশাসককে প্রয়োজন। তাকে অবশ্যই আদর্শ দেশ ও সমাজ গঠনে ভূমিকা পালন করতে হবে।