বৈধ কাগজপত্র না থাকার পরেও কেউ যদি ব্যক্তি মালিকানাধীন, সরকারি খাস ভূমি বা কোন সংস্থার জমি জোর করে দখল করে রাখেন, সেজন্য এক বছর থেকে তিন বছরের কারাদণ্ড, এক লক্ষ থেকে তিন লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। এদিকে গত রোববার গাজীপুর জেলার ১৯২টি পুকুর আংশিক বা সম্পূর্ণ দখলদারদের তালিকাসহ বর্তমান অবস্থাসংবলিত প্রতিবেদন তৈরি এবং দখলদার উচ্ছেদ ও পুনরুদ্ধারে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে আদালতে দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালককের প্রতি এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

 এ প্রেক্ষিতে গাজীপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নগর ভবন সংলগ্ন সরকারি পুকুর দখলসহ ভরাট করে অবৈধ বাণিজ্যিক ও আবাসিক স্থাপনা নির্মাণ করে অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগে তাসলিমা নয়নসহ দখলকারীরা শিঘ্রই জেল-জরিমানার মুখোমুখি হবেন। গাজীপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাহিম সরকার, গাজীপুর জেলা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’র সভাপতি অ্যাডভোকেট আনোয়ার সাদত সরকারসহ অনেকেই গাজীপুর সিটি করপোরেশন সংলগ্ন পুকুর, জোড় পুকুর, মুন্সিপাড়া পুকুরসহ জেলার বিভিন্ন পুকুর উদ্ধারের বিষয়টি জেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায় উপস্থাপন করলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। এমতাবস্থায় বিষয়টি উচ্চ আদালত উঠেছে। গত রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) রিট শুনানি শেষে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব এবং বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ গাজীপুর জেলার ১৯২টি সরকারি পুকুর রক্ষা এবং দখলদারের তালিকাসহ পুকুরের বর্তমান অবস্থা এবং অবৈধভাবে দখলদারদের উচ্ছেদ ও পুকুর পুনরূদ্ধারে পরিকল্পনা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

একই সাথে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) তথ্য অধিকার আইনে করা আবেদনের নিষ্পত্তি করতে বলেছেন আদালত। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) জনস্বার্থে রিটটি (রিট নং ১০৪৯৩/২০২২) দায়ের করে। আদালতে বেলা’র পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট মিনহাজুল হক চৌধুরী এবং তাঁকে সহযোগিতা করেনঅ্যাডভোকেট এস. হাসানুল বান্না। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আবুল কালাম খান। দখল করা ১৯২টি পুকুরসহ গাজীপুর জেলার ৮৮৭টি সরকারি খাস পুকুরের অবস্থানসহ (মৌজার নাম, দাগ নম্বরসহ) পূর্ণাঙ্গ তালিকা, দখলদারদের তালিকা এবং ইজারা দেওয়া হলে ইজারা গ্রহীতাদের তালিকা দিতে অনুরোধ করে বেলা ১৪ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছিল। এ আবেদন নিষ্পত্তি করতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রুলে গাজীপুর জেলার ১৯২টি পুকুর অননুমোদিত ভরাট, দখল, শ্রেণি পরিবর্তন ও দূষণ রোধে বিবাদীদের ব্যর্থতা কেন আইনবহির্ভূত ও জনস্বার্থবিরোধী ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থে ১৯২টি পুকুর পুনরুদ্ধার এবং ৮৮৭টি পুকুর সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা–ও রুলে জানতে চাওয়া হয়েছে।

ভূমিসচিব, পরিবেশসচিব, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও গাজীপুর জেলা প্রশাসকসহ বিবাদীদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।   বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, গাজীপুর জেলার আংশিক বা সম্পূর্ণ দখলকৃত ১৯২টি পুকুরে বিদ্যমান দখলদারের তালিকাসহ পুকুরের বর্তমান অবস্থা সম্বলিত প্রতিবেদন তৈরি এবং পুকুরগুলোতে বিদ্যামান দখলদার উচ্ছেদ ও তা পুনরূদ্ধারে একটি কর্ম পরিকল্পনা প্রস্তুতের জন্য গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এবং গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তর উপপরিচালককে এ নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এছাড়াও ২০২২ সালের ৩ এবং ৪ জুলাই গাজীপুরের জেলা প্রশাসনের বরাত দিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত ‘১৯২ সরকারি পুকুর বেদখল’ এবং ”গাজীপুরে ‘নীতিমালা উপেক্ষা’ করে প্রভাবশালীদের পুকুর ইজারা দিচ্ছে জেলা প্রশাসন!” শিরোনাম প্রকাশিত সংবাদ তদন্ত করে দখল করা ১৯২টি পুকুরসহ গাজীপুর জেলার ৮৮৭ টি সরকারি খাসপুকুরের অবস্থানসহ (মৌজার নাম, দাগ নং সহ) পূর্নাঙ্গ তালিকা, দখলদারদের তালিকা ও ইজারা দেয়া হলে ইজারা গ্রহীতাদের তালিকা চেয়ে অনুরোধ জানিয়ে গাজীপুরের জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো বেলার চিঠির নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। 

রিটে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালককে বিবাদী করা হয়েছে।প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন এ আদেশের পাশাপাশি আদালত রুল জারি করেছেন। রুলে গাজীপুর জেলার ১৯২টি পুকুরের অননুমোদিত ভরাট, দখল, শ্রেণিপরিবর্তন ও দূষণরোধে বিবাদীগণের ব্যর্থতা কেন আইন বহির্ভূত, জনস্বার্থ বিরোধী এবং অসৎ উদ্দেশ্যে প্রণোদিত ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়েছে আদালত। সেই সাথে জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থে দখলকৃত ১৯২টি পুকুর পুনরুদ্ধার এবং ৮৮৭টি পুকুর সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কেন নির্দেশ দেয়া হবে না তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ৩ জুলাই গাজীপুরের জেলা প্রশাসনের বরাত দিয়ে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত ‘১৯২ সরকারি পুকুর বেদখল’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী গাজীপুর জেলায় সরকারি বা খাস পুকুরের সংখ্যা ৮৮৭টি। এর মধ্যে ২২ শতাংশ অর্থাৎ ১৯২টি পুকুর পুরোপুরি বা আংশিক ভরাট করা হয়েছে। এর আয়তন প্রায় ১৫১ একর।

ওই সংবাদ অনুযায়ী জেলার ৮৮৭টি পুকুরের মধ্যে মহানগর ও সংলগ্ন এলাকায় পুকুর থাকার কথা ৩৯০টি, রয়েছে মাত্র ২৩৬টি। অর্থাৎ মহানগর ও আশপাশের এলাকার ৩৯শতাংশের বেশি পুকুর (প্রায় ১৫৪টি) পুকুর দখল ও ভরাট করা হয়েছে। পুকুরগুলো ভরাট ও দখল করে সেখানেগড়ে তোলা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বাড়ি ও মার্কেট। ওই সংবাদের ভিত্তিতে বেলা জনস্বার্থে রিট মামলা দায়ের করে এবং তথ্য অধিকার আইনে ৮৮৭টি পুকুরের অবস্থানসহ (মৌজার নাম, দাগ নং সহ) পূর্নাঙ্গ তালিকা চেয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তার কাছে আবেদন করে। ওই আবেদনের কোন জবাব না দেয়ায় ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দাখিল করে বেলা। আবেদনের প্রেক্ষিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্যপ্রদানকারী কর্মকর্তা তথ্য প্রদান না করায় তাঁর বিরুদ্ধে গত ১৩ নভেম্বর বিভাগীয় কমিশনার ও আপীল কর্মকর্তার কাছে আপীল করেন বেলা।

আপীল আবেদনটি গ্রহণ করে আপীল কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে তথ্য প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন। এ নির্দেশের পর প্রায় ২ মাস হলেও তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা তথ্য প্রদান করেনি। তাই বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ২০২২ সালের ৩ জুলাই জেলা প্রশাসনের বরাতে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত ‘১৯২ সরকারি পুকুর বেদখল’ শীর্ষক সংবাদ তদন্ত করে দখলকৃত ১৯২টি পুকুরসহ গাজীপুর জেলার ৮৮৭টি সরকারি খাসপুকুরের অবস্থানসহ (মৌজার নাম, দাগ নং সহ) পূর্নাঙ্গ তালিকা, দখলদারদের তালিকা ও ইজারা দেয়া হলে ইজারা গ্রহীতাদের তালিকা প্রদানের এবং পুকুরগুলোর ভরাট ও দখলসহ সাম্প্রতিক অবস্থার ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা এবং বেলাকে প্রতিবেদনের কপি প্রদানের অনুরোধ জানিয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর পত্র প্রেরণ করেন। বেলার দেয়া ওই চিঠির নিষ্পত্তি করতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।