স্থানীয় কৃষকরা জানান, পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষাবাদ শুরু হয়েছে ১৯৪০ সাল থেকে, যদিও এর আবাদ হয়েছিল ২০০ বছরেরও বেশি সময় আগে। এই গাছটি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ঝালকাঠিতে এ বছর বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় ঝড়ে পড়েছে পেয়ারা গাছ। আশানুরূপ ফলন না পাওয়ার আশঙ্কায় দিশেহারা পেয়ারা চাষিরা। দেখা গেছে, পেয়ারার চাষ কমবেশি সব জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলেও মূলত ঝালকাঠি সদর ও পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির আশেপাশেই বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারার চাষ হয়। ঝালকাঠি জেলার ১৩টি গ্রামে ৩৫০ হেক্টর, স্বরূপকাঠির ২৬টি গ্রামে ৬৪৫ হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়। এসব এলাকার হাজার হাজার মানুষের জীবিকার একমাত্র মাধ্যম পেয়ারা। আষাঢ়-শ্রাবণ পূর্ণ বর্ষাকালে এসব এলাকার নদী-নালার ধারে পেয়ারা গাছ দেখা যায়।

এদিকে ঝালকাঠির কীর্তিপাশা, ভিমরুলি, শতসকাঠি, খাজুরিয়া, ডুমুরিয়া, কাপুরকাঠি, জগদীশপুর, মিরকাঠি, শাখা গাছির, হিমানন্দকাঠি, আদাকাঠি, রামপুর, শিমুলেশ্বর গ্রামে যুগ যুগ ধরে বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারা চাষ হচ্ছে। তবে এবার গাছে ফুল দেরিতে এসেছে। কিন্তু বৃষ্টি না হওয়ায় সেই ফুল ঝড়ে পড়েছে। পেয়ারা মাঝামাঝি পাকা অবস্থায়ও মুকুল থাকে। এটি বিক্রয়যোগ্য হতে আরও এক মাস সময় লাগবে। তাই বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষাবাদ শুরু হয়েছে ১৯৪০ সাল থেকে, যদিও এর আবাদ হয়েছিল ২০০ বছরেরও বেশি সময় আগে। এই গাছটি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২২ সালে, কমপক্ষে ১,৯৩২ হেক্টর জমি বাণিজ্যিক পেয়ারা চাষের অধীনে ছিল। এ সময় প্রায় ২০ হাজার টন পেয়ারা তোলা হয়েছে। কিন্তু এ বছর ফলন কম হওয়ায় ১০ হাজার টন পেয়ারা উৎপাদন হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে পেয়ারা চাষিদের।

কৃষক পঙ্কজ বড়াল জানান, মাঘ-ফাল্গুন মাসে পেয়ারা গাছের গোড়া পরিষ্কার করে সার দিতে হয়। এর পরে, আমি ভেজা মাটি দিয়ে স্টাম্প ঢেকে দিলাম। প্রতিটি গাছের গোড়ায় গড়ে তিন শতাধিক টাকা খরচ হয়েছে। এ বছর বৃষ্টি না হওয়ায় ঝড়ে পেয়ারা গাছে যে পরিমাণ ফুল এসেছে তা হারিয়ে গেছে। লাভ তো দূরের কথা, প্রকৃত খরচ উঠবে কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। ক্ষোভ প্রকাশ করে পঙ্কজ বলেন, সরকার কৃষকদের অনেক কিছু দেয়।

আমি একজন প্রান্তিক ও দরিদ্র কৃষক। সারাদিন কৃষি নিয়ে পড়ি। তাই কারো কাছে যেতে না পারায় কোনো কৃষি সার ও বীজ পাইনি। কৃষক দেবব্রত হালদার বিট্টু জানান, পেয়ারা আমাদের মৌসুমি আয়ের একমাত্র উৎস। পেয়ারার ফলন ভালো হলে আমরা সচ্ছল হব। পানির ওপর ভাসমান বাজারে বছরে লাখ লাখ টাকার লেনদেন হয়। বিক্রেতারা পাইকারী বিক্রেতা হিসাবে কিছু অস্থায়ী দোকান স্থাপন করে, পর্যটক/দর্শনার্থীদের বিনোদন দিয়ে বা ক্ষুধা নিবারণের মাধ্যমে ব্যবসা করে আর্থিক লাভবান হয়। কিন্তু এ বছর পেয়ারার ফলন কম হওয়ায় পাইকারি আসাসহ সবকিছুর ওপর এর খারাপ প্রভাব পড়বে।

অপর এক কৃষক বিপুল চক্রবর্তী বলেন, আমরা তিনজন পরিবারে পেয়ারা বাগান পরিচর্যাসহ সব ধরনের কাজে নিয়োজিত। বছরের এই মৌসুমে সারা বছরের আয় দিয়ে আমাদের সংসার চলে। এ বছর ফলন হওয়ায় মৌসুমের তিন মাস সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। বাকি সময়টা কেমন কাটবে একমাত্র আল্লাহই জানেন। পর্যটন ব্যবসায়ী নিশীথ হালদার জানান, পেয়ারা মৌসুমে হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক আসেন। আগে শুধু সমুদ্রপথে আসতেন, এখন রাস্তা ভালো হওয়ায় এবং অল্প সময়ে যাতায়াত সম্ভব হওয়ায় গত বছর থেকে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। আমরা পেয়ারা বাগানের একটি নান্দনিক সফর নিয়েছিলাম কারণ পেয়ারা চাষীরা তাদের বাগানের ক্ষতি করছে। কিন্তু এ বছর পেয়ারার ফলন খুব বেশি পর্যটক বা দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করবে বলে মনে হয় না।

কারণ পর্যটক বা দর্শনার্থীরা ফেরার পথে কিছু পেয়ারা সঙ্গে নিয়ে যান। পেয়ারার ফলন কম হওয়ায় চারদিক থেকে লোকসানের মুখে পড়বে এখানকার মানুষ। 
পেয়ারা চাষি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ভবেন হালদার বলেন, কৃষি ফলনের জন্য সবচেয়ে উপকারী স্বাভাবিক পরিমাণ বৃষ্টি। তবে এ বছর পেয়ারা গাছের সঠিক পরিচর্যা করা হলেও বৃষ্টির অভাবে ঝড়ে বেশিরভাগ ফুলই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন পেয়ারা গাছে যে মুকুল আছে তাতে খরচ পোষানোই দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে । 

ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ঝালকাঠি সদর উপজেলার ১৩টি গ্রামে ৩৫০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারার চাষ হয়। পেয়ারার মৌসুমে 'পেয়ারা' এলাকার হাজার হাজার মানুষের অর্থনৈতিক স্বস্তি ও জীবিকার উৎস। বৃষ্টির অভাবে ফুলগুলো কিছুটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। তবে যা আছে তা সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করলে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তিনি আরো বলেন, সরকারি প্রণোদনার সার ও বীজ কৃষকদের মাঝে সমানভাবে বিতরণ করা হচ্ছে।