যে পরিমাণ অর্থ দেশে আনা হবে, তার ওপর কোনো শর্ত ছাড়াই শুধু ১০ শতাংশ আয়কর দিয়ে বৈধ করা যাবে।

দেশ থেকে বিভিন্ন দেশে যে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হচ্ছে, তা এখন সরকারও স্বীকার করছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত সপ্তাহে ক্রয় কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘অনেক টাকা বিদেশে চলে গেছে। পাচার করা টাকা যাতে দেশে ফেরত আসে, সে জন্য উদ্যোগ নেয়া হবে।’এ পদক্ষেপের কথা জানা যাবে নতুন বাজেটে, যা আগামী ৯ জুন জাতীয় সংসদে ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী।অর্থ মন্ত্রণালয় ও রাজস্ব বোর্ড কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দেশে থেকে যে টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, ওই টাকা কেউ দেশে ফেরত আনতে চাইলে বিশেষ সুযোগ দেয়া হবে।যে পরিমাণ অর্থ দেশে আনা হবে, তার ওপর কোনো শর্ত ছাড়াই শুধু ১০ শতাংশ আয়কর দিয়ে বৈধ করা যাবে। এর জন্য তার আয়ের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, দুর্নীতি দমন কমিশন, এমনকি সরকারি অন্য কোনো গোয়েন্দা সংস্থা কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করবে না।ওই ব্যক্তি তার বার্ষিক আয়কর রিটার্নে ঘোষিত অর্থ উল্লেখ করতে পারবেন। অর্থাৎ নির্ধারিত হারে কর পরিশোধ করে পাচারকারীরাও কালো টাকা সাদা করতে পারবেন।নগদ টাকার পাশাপাশি বিদেশে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থাকলে সেই সম্পত্তি আয়কর রিটার্নে দেখাতে পারবেন। এ জন্য ১৫ শতাংশ কর দিলে কোনো প্রশ্ন করা হবে না।চলতি বছরের জুলাই থেকে আগামী ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এ সুযোগ দেয়া হচ্ছে। ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ওই টাকা দেশে আনা যাবে।



এ ক্ষেত্রে পাচারের টাকা অ্যাকাউন্টে জমা হওয়ার আগেই কর পরিশোধ করতে হবে সরকারকে। বর্তমানে নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, শেয়ারবাজার, সঞ্চয়পত্রে ২৫ শতাংশ এবং তার সঙ্গে ‘অতিরিক্ত’ ৫ শতাংশ জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া আছে। এর বাইরে আসন্ন বাজেটে পাচার করা অর্থও বৈধ করার সুযোগ দিতে যাচ্ছে সরকার।ইপিজেড ও হাইটেক পার্কে নতুন শিল্প উৎসাহিত করতে ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে।অপ্রদর্শিত বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার দিয়ে আসছে। তবে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার ক্ষেত্রে এ ধরনের সুযোগ আগে কখনও দেয়া হয়নি বাজেটে। প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশই পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে নানা সুবিধা দিয়েছে এবং পাচার বন্ধে কঠিন আইনও করেছে।অর্থ পাচার প্রমাণিত হলে জেল-জরিমানার মতো কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়। সেই অপরাধীদের কিছু সুবিধা দিয়ে দণ্ড মাফ করতে যাচ্ছে সরকার।রাজস্ব বোর্ডের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হলেও আইনি জটিলতার কারণে তা ফেরত আনা যাচ্ছে না। কিছু সুবিধার বিনিময়ে পাচারকারীরা স্বপ্রণোদিত হয়ে ঘোষণা দিলে ওই টাকা অর্থনীতির মূল ধারায় যোগ হবে। এতে সরকার ও পাচারকারী উভয়ই লাভবান হবে।একশ্রেণির ব্যবসায়ী আমদানি পণ্যের দাম বেশি এবং রপ্তানি পণ্যের দাম কম দেখিয়ে অর্থ পাচার করেন। কর ফাঁকি ও হুন্ডির মাধ্যমেও প্রতি বছর বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার হয়ে থাকে।দেশ থেকে অর্থ পাচারের ঘটনায় সরকারি ও বিরোধী দলের সাংসদরা জাতীয় সংসদের বাইরে ও ভেতরে বিভিন্ন সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ নিয়ে গত বছর সংসদে তোপের মুখে পড়েন অর্থমন্ত্রী। বিরোধী সাংসদদের কাছে অর্থ পাচারকারীদের নাম দিতে বলেছেন তিনি।বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) পাঁচ বছরে ১ হাজার ২৪টি পাচারের ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে।



বিএফআইইউর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৫৮টি, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১২১টি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬৭৭টি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫২টি ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১১৬টি অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটে। সংস্থাটির প্রতিবেদনে পাচারকারীরা দেশের বাইরে কোথায় ফ্ল্যাট ও বাড়ি কিনেছেন কিংবা বিনিয়োগ করেছেন, সেগুলোর বিবরণও আছে।এসব তথ্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), এনবিআর, বাংলাদেশ পুলিশ, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠানো হলেও খুব কম ক্ষেত্রে তদন্ত ও ব্যবস্থা নেওয়া হয়।পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার কথা বলা হলেও দেশ থেকে কত টাকা পাচার হয়েছে তার কোনো তথ্য সরকারের হাতে নেই।ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকা।পাচারকারীদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার উদ্যোগকে ‘অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য’ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা। তাদের মতে, এতে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার আরও উৎসাহিত হবে এবং যারা নিয়মিত ও সৎ করদাতা তাদের প্রতি অবিচার করা হবে।অর্থ পাচারকারীদের দণ্ড মাফ করে দেয়ার উদ্যোগ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘এটি আইন ও দেশের সংবিধান পরিপন্থি।’ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, ‘কর ছাড় দিয়ে পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের যে উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে, তা অনৈতিক। এতে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হবেন।’পাচারকারীদের সুবিধা দিলে দেশে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার আরও উৎসাহিত হবে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান।