নৈতিক শিক্ষার প্রথম যে দিকটি রয়েছে তা হচ্ছে যে, শিশুকে বুঝিয়ে দেওয়া নৈতিক শিক্ষা কি?পরিবার, সমাজ, বিদ্যালয়, বন্ধু-বান্ধব এবং নিকট পরিবেশ মূলত এ সকল স্থান থেকেই একজন শিশু তার পার্থিব জীবনের নৈতিকতার প্রাথমিক ধারণা প্রকাশ পায়। সেই সময় যদি শিশুকে ভালো ও মন্দের পার্থক্য বুঝানো যায়, কোন কাজটি করা যায় কোনটি করা যায় না, কোনটা খারাপ গুণ কোনটা ভালো গুণ, কোনটা কল্যাণকর কোনটা অকল্যাণকর,কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা, এ সকল বিষয়ে যৌক্তিক ধারণা দিয়ে শিশুর মাঝে যৌক্তিক শক্তির বিকাশ ঘটাতে নৈতিক শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম। বিষয়টি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা হলে শিশু নৈতিক শিক্ষা সম্পর্কে জানতে বেশী আগ্রহী হবে এবং তা অর্জনের জন্য চেষ্টা করবে। তবে নৈতিক শিক্ষা কোন সহজ বিষয় নয় এটি হলো অর্জনের বিষয়।
নৈতিক শিক্ষার প্রাথমিক যে মাধ্যম হচ্ছে তার পরিবার। কেননা একটি শিশু তার শিশুকালে তার পরিবারের সঙ্গে অতিবাহিত করে তার পরিবারের সংগে এবং তার জীবনের যত বাস্তব ঘটনা ঘটে সবগুলোই তার পরিবারের লোকজনের কাছ থেকেই। শিশু তার নিজের চিন্তা ভাবনা এবং আদর্শ অনুসারে যদি জীবন যাপন করতে চায় তাহলে তার নিজ পরিবারকে এ বিষয়ে প্রথমেই সচেতন থাকতে হবে।
নৈতিক শিক্ষা একটি শিশুর জীবনে প্রথমেই যে গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয় তা হচ্ছে তার চারিত্রিক বিকাশ ঘটানো। নৈতিক শিক্ষা বলতে মূলত চরিত্রকে বোঝানো হয়েছে কেননা, ইহার মাধ্যমে শিশু তার চারিত্রিক বিকাশের উন্নতি করে এবং নৈতিকতার প্রকাশ করে। আর নৈতিকতা হচ্ছে মূলত: একটি শিশুর এবং সর্বোপরি একজন ব্যক্তির প্রধান দিক,জীবনে কিছু ভালো অর্জন করার জন্য।
ব্যক্তি ও সমাজ পরস্পর নির্ভরশীল। ব্যক্তি যদি তার বাবা-মা তথা পরিবার বা নিজস্ব পরিবেশ থেকে ভালোর শিক্ষা গ্রহণ করে,তাহলে সে ভালো নৈতিক জীবন গড়ে তোলতে পারবে। আর যদি ব্যক্তি সর্বক্ষেত্রে মন্দের শিক্ষা পায়, তাহলে অনৈতিকতার মধ্যে জীবন যাপনে অভ্যস্থ হয়ে যাবে ।
দুর্ভাগ্যের বিষয় আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র এতোটাই নৈতিক ভাবে নিম্নগামী হয়েছে যে সর্বত্রই মন্দ লোকদের আর মন্দ স্বভাবের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এভাবে আইন যদি হয় নৈতিকতার পক্ষে,ব্যক্তির পক্ষে,তবে তা অগ্রাহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে।বিপরীত অর্থে আইন যদি হয় নৈতিকতা বা ব্যক্তির বিপক্ষে তাহলে ব্যক্তি মন্দ পথ খুঁজে নেবে। তাই জেনা- ব্যভিচারের মতো অন্যায় অপকর্মকে প্রতিরোধ করার জন্য ব্যক্তির সংশোধন যেমন অনিবার্য তেমনি সমাজের ন্যায়নিষ্ঠ পরিবর্তনও আবশ্যক।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট বলেছিলেন "আমি বাবার কাছে ঋণী জীবনের জন্য, কিন্তু আমার শিক্ষকের কাছে ঋণী আমার সুন্দর জীবনের জন্য।" আছিয়াদের সুন্দর জীবন নষ্টের জন্য দায়ী কে? আছিয়াদের মৃত্যু আমাদের কি বার্তা দিচ্ছে? সময় এসেছে তা অনুসন্ধানের। প্রতিটি জীবনের জন্য মৃত্যু অনিবার্য। অস্বাভাবিক মৃত্যু অস্বাভাবিকতা নিয়েই আমাদের বুকে হিমালয়ের মত ভারী হয়ে চেপে বসেছে। সেই চাপাকান্না বুকে নিয়েই জীবন কাটে আছিয়াদের পরিবার।
ইউনিসেফের তথ্যমতে, পৃথিবীতে এই মুহূর্তে জীবিত ৩৭ কোটি নারী, অর্থাৎ প্রতি আট জনে একজন নারী ১৮ বছর বয়স হবার আগেই ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে গত আট বছরে ৩ হাজার ৪৩৮ টি শিশু ধর্ষণের মামলা দায়ের হয়েছে, ধর্ষণের শিকার হয়েছে আরও বেশি।
এদের মধ্যে অন্তত ৫৩৯ জনের বয়স ছয় বছরের কম। আর সাত থেকে বারো বছরের মধ্যে আছে ৯৩৩ জন।
গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয়, নিকট প্রতিবেশী ও পরিচিতদের দ্বারাই শিশুরা যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার হয়।
অধিকারকর্মীরা বলছেন, সেক্ষেত্রে সবার আগে সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে বাবা-মায়ের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কেবল ঘরের বাইরের বা অপরিচিতদের ক্ষেত্রেই না, পরিচিত-নিকটাত্মীয়দের ব্যাপারেও সচেতন হতে হবে।
একইসঙ্গে শিশুদের যৌন শিক্ষা দেওয়া এবং কোন ধরনের স্পর্শ ভালো আর কোনটা খারাপ- এবিষয়ে সচেতন করার মতো বিষয়গুলোও পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করা জরুরি।
তবে অধিকারকর্মী সুলতানা বলেন, "পাঠ্যক্রমে আমাদের এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো এবং সেটা নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছে যে বিষয়গুলো সহজে নিতে পারছে না। এমনও হয়েছে যে পাতাগুলো স্টাপলার করে রাখা হয়েছে।"
ফলে সচেতনতা যেমন তৈরি হয়নি, তেমনি বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরাও। এক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার মাধ্যমে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ বেছে নিতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং আইনের প্রয়োগ না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলেও সতর্ক করছেন তারা।
পাশাপাশি অপরাধ রোধের জন্য সর্বস্তরে নৈতিক শিক্ষা বিশেষ করে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা অপরিহার্য। ধর্মীয় শিক্ষাই হলো নৈতিক শিক্ষার মূল ভান্ডার। এ ব্যাপারে ধর্মীয় অনুশাসনের ভিত্তিতে ধর্ষণ-ব্যভিচার প্রতিরোধে নিম্নোক্ত বিষয় গুলোর গুরুত্ব বিবেচনায় পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহবান সরকারের নীতি নির্ধারকদের প্রতি ।
#. নারীর অধিকার ও মর্যাদা সংরক্ষণে ধর্মীয় শিক্ষাসমূহ পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
#. নারীর অশ্লীল উপস্থাপনা ও তাদের পণ্য হিসেবে ব্যবহার রোধ করতে হবে।
#.পর্নোগ্রাফির ও অশ্লীল ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট নিষিদ্ধসহ এ ব্যাপারে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
#.ধর্ষণ-জেনা-ব্যভিচারের সর্বোচ্চ শাস্তি ৯০ দিন থেকে ১২০দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ শাস্তি জনসম্মুখে নিশ্চিত করতে হবে।
#. মাদকদ্রব্যের অবাধ প্রাপ্তির উৎসমূলে ও ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
#. আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগসহ হস্তক্ষেপমুক্ত বিচার নিশ্চিতকরতে হবে।
ক্রমাগত ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মত অপরাধগুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে। আছিয়ার উপর পরিচালিত নির্মম নির্যাতন এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যু নিয়ে দেশব্যাপী সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা নারী নির্যাতন বন্ধে সম্ভাবনার আশা জাগিয়েছে। সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ সোচ্চার হতে শুরু করেছে। "আছিয়া"এখন নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদের প্রতীক। যেমন সীমান্ত হত্যার প্রতীক হয়ে আছেন "ফেলানী"।
ফেলানী থেকে আছিয়া ক্ষণজন্মা হয়ে আসবে আর আমাদের অপরাধ প্রবণতার বলী হয়ে, এভাবে প্রাণবিসর্জন দিবে তা আর হতে দেয়া যায় না ।