পুতুলনাট্য বা পাপেট শো হলো একটি সমন্বিত শিল্পকলা। নিষ্প্রাণ প্রতিমূর্তি দিয়ে একজন শিল্পী নাটকীয় কলাকৌশলের মাধ্যমে যেকোনো বিষয় উপস্থাপন করেন। এটি লোকসংস্কৃতির অন্যতম একটি শাখা। পাপেট শো বা পুতুলনাচ কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, এর মাধ্যমে যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষণীয় বার্তা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। 

এই পাপেট নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে ‘কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটার’ নামের একটি নাটকের দল। এই থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আসাদুজ্জামান আশিক। এরই মধ্যে এ কাজে প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। এ নিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। আসাদুজ্জামান আশিক জানান, বিভিন্ন ধরনের পুতুলের মাধ্যমে পাপেট শো করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে, সুতা পুতুল, রড পাপেট, শ্যাডো বা ছায়া পুতুল, ফিংগার পাপেট, ওয়াটার পাপেট, দস্তানা পুতুল মাপেট। বাংলাদেশে সুতা পুতুলনাট্য, রড পাপেট, ছায়া পুতুল, ফিংগার পাপেট, গ্লাভস পাপেট ও মাপেটের প্রচলন রয়েছে। কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটার মূলত ফিংগার পাপেট নিয়ে কাজ করে। এ ছাড়া বিভিন্ন শোয়ের প্রয়োজনে সুতা পুতুল, গ্লাভস পাপেট ও মাপেট ব্যবহার করেন তাঁরা। কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটার নিজের পুতুল ‍নিজেরাই তৈরি করে বলে জানান তিনি। পাপেট থিয়েটারের কাজ সম্পর্কে আশিক বলেন, শিশুদের আনন্দদায়ক শিক্ষা ও বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটার কাজ করে। এ ছাড়া বয়স্কশিক্ষা, কুসংস্কার, সমাজ সচেতনতা ও বিভিন্ন ক্যাম্পেইনে এ পাপেট ব্যবহার করা হয়। 

কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটারের প্রযোজনার মধ্যে রয়েছে, ‘দুই বন্ধু ও ভাল্লুক’, ‘নিরাপদ সড়ক’, ‘খুশির গল্প’, ‘স্বাধীনতার গল্প’, ‘গাছ বন্ধু’, ‘হাতি রক্ষা’ ইত্যাদি। এ ছাড়াও বিভিন্ন পথনাটক ও মাপেট নিয়ে ক্যাম্পেইন করেছে তারা। ২০১৯ সালের ২৬ আগস্ট ‘কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করেন আসাদুজ্জামান আশিক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থীরা মিলে সংগঠনটি শুরু করেন। তিনজন নিয়ে সংগঠনটি শুরু হলেও পরে সেই সংখ্যা সাতজনে দাঁড়ায়। সংগঠনের সদস্যরা হলেন, আসাদুজ্জামান আশিক, প্রণয় সরকার, শাহনাজ শানু, সোহানা তানজিম, তুনতুন মজুমদার, জুবায়ের কিশোর, ফারহানা আফরিন তিথি। এ ছাড়া তারেক, শিল্পী, নিশি, রিশা বিভিন্নভাবে কাজ করে সংগঠনকে সহায়তা করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রোগ্রাম করেছেন তাঁরা। বগুড়ার পল্লি উন্নয়ন একাডেমি, নেত্রকোনার বিদ্যাভুবন, ময়মনসিংহের ডাচ বাংলা একমাত্রা স্কুল, হালুয়াঘাটের আদিবাসী নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়, বাংলাবান্ধা ১ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অবকাশ শিশু নিকেতন, মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আমরা সবাই রাজা ক্লাব, ময়মনসিংহের ব্রাদার হাউস, সুগম, ব্রিটিশ কাউন্সিল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ক্যাম্পেইন, গ্রো ইয়োর রিডার, বগুড়ার চরপাকুটিয়া, চট্টগ্রামের নগরফুল শিরীষতলা, স্বপ্ন বাগিচা বিদ্যানিকেতনসহ অনেক জায়গায় তাঁরা পারফর্ম করেছেন। কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য জানতে চাইলে আশিক বলেন, ‘শিশুদের আনন্দদায়ক শিক্ষা, প্রান্তিক জনগণের মধ্যে পুতুল ব্যবহার করে বিভিন্ন কুসংস্কার দূর করে সামাজিক সচেতনতা তৈরি, সমকালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুতুল নাটকের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে নতুন পুতুল নির্মাণ ও সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে বিনোদন দেওয়া আমাদের মূল লক্ষ ও উদ্দেশ্য। এ ছাড়া পাপেট ব্যবহার করে যৌনশিক্ষা প্রদান করাও আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র দিয়ে পাপেট বানানো হয় বলে জানান আশিক। এ ছাড়া ককশিট, থার্মোকল, আঠা, সুই সুতা, কাপড় ইত্যাদি দিয়ে পাপেট বানানো হয় বলে জানান তিনি। 

দলটির সদস্য শাহানাজ শানু বলেন, ‘কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটার শিশুদের আনন্দময় শিক্ষার মাধ্যমে একদিন তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে। কাকতাড়ুয়া সমাজসংস্কারক হিসেবে একদিন সারা দেশে সুনাম অর্জন করবে বলেও আমি আশাবাদী। কাকতাড়ুয়ার আরেক সদস্য ফারহানা আফরিন তিথি বলেন, ‘আমরা সাধারণত শিল্পকে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করি এবং শিল্প-সাহিত্য আমাদের রোজকার জীবনে স্বস্তি এনে দেয়। কিন্তু শিল্প-সাহিত্যের একটি সূক্ষ্ম প্রয়োগ হলো শিক্ষা দান এবং সচেতনতা প্রদান। গল্প বলার মাধ্যমে মানুষকে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে সচেতন করা বা শিক্ষিত করে তোলার পদ্ধতিটি বেশ প্রাচীন এবং জনপ্রিয়। পাপেট এমন একটি শিল্পমাধ্যম, যেখানে গল্প হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত এবং গল্পের অন্তর্নিহিত বোধ শিশু থেকে বৃদ্ধ—সব মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটারের উদ্যোগ এবং কার্যপদ্ধতি বেশ প্রশংসনীয়। শিশুবান্ধব শিক্ষাক্রম পরিকল্পনা বাস্তবায়নের স্বপ্নটি নিয়ে কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটার যাত্রা শুরু করেছে, তা যেন অতি দ্রুত বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হয়।’ 

ভ্রমণ করতে ভালো লাগা আর পাপেটের প্রতি ভালোবাসা থেকে কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটারের নিয়ে যাত্রা করেন আশিক। কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটার অদ্যাবধি যে কয়টি নিজস্ব শো করেছে, তার বেশির ভাগই নিজস্ব অর্থায়নে। যেকোনো ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা কাকতাড়ুয়া পাপেট থিয়েটারের পথচলাকে আরও মসৃণ করবে বলে জানান আশিক।