বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারী কৃষকদের অবদান অপরিসীম। বীজ বপন থেকে শুরু করে ফসল কাটা, সবজি উৎপাদন থেকে পশুপালন—সবখানেই নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে। তবুও প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, বাজার সংযোগ ও আর্থিক সহায়তায় নারীরা এখনও পিছিয়ে আছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষি সম্প্রসারণ সেবা নারীদের ক্ষমতায়ন এবং কৃষি খাতের উন্নয়নে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।
নারী কৃষকদের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, কৃষি খাতে প্রায় ৪৩ শতাংশ শ্রমশক্তি নারী। তবে এদের একটি বড় অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করে এবং তাদের অবদান প্রায়ই অর্থনৈতিক মূল্যে পরিমাপ হয় না।
গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার কৃষক রাবেয়া বেগম জানান,
“আমরা মাঠে ধান লাগাই, ঘরে বীজ সংরক্ষণ করি, কিন্তু নতুন জাতের ধান বা সবজি চাষের পদ্ধতি নিয়ে প্রশিক্ষণ খুব একটা পাই না।”
কৃষি সম্প্রসারণ সেবার ভূমিকা
কৃষি সম্প্রসারণ সেবার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষকদের কাছে নতুন প্রযুক্তি, চাষাবাদের আধুনিক কৌশল এবং বাজার সংক্রান্ত তথ্য পৌঁছে দেওয়া। নারীদের জন্য এই সেবার বিশেষ উপযোগিতা হলো—
• প্রযুক্তি স্থানান্তর – নারীরা যাতে সহজে ব্যবহারযোগ্য যন্ত্রপাতি ও আধুনিক পদ্ধতি শিখতে পারেন।
• ফসল ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ – বীজ নির্বাচন, সার প্রয়োগ, সেচ ব্যবস্থাপনা ও রোগ-পোকার দমন শেখানো।
• বাজার সংযোগ – ফসল বিক্রির সময়, দাম নির্ধারণ ও বাজার প্রবেশাধিকার নিয়ে পরামর্শ।
• ঋণ ও সহায়তা প্রকল্প – সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কৃষি ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ তৈরি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন,
“নারী কৃষকদের জন্য আলাদা ফার্মার ফিল্ড স্কুল, প্রদর্শনী প্লট এবং ডিজিটাল পরামর্শ কেন্দ্র চালু করা গেলে তারা আরও আত্মনির্ভরশীল হবে।”
জরিপে যা উঠে এসেছে
বিষয় শতাংশ (%)
নারী কৃষকেরা প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ পান ৩৫%
বাজার তথ্যের নিয়মিত অ্যাক্সেস আছে ২৫%
কৃষি সম্প্রসারণ সেবার সাথে যোগাযোগ রাখেন ৪০%
নারী কৃষক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে দক্ষ ১৮%
সম্ভাবনার ক্ষেত্র
1. ডিজিটাল সেবা সম্প্রসারণ – মোবাইল অ্যাপ, এসএমএস ও অনলাইন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দূরবর্তী অঞ্চলের নারী কৃষকের কাছে সেবা পৌঁছানো।
2. গোষ্ঠীভিত্তিক কৃষি কার্যক্রম – সমবায় ও গ্রুপভিত্তিক চাষাবাদে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো।
3. অ্যাগ্রো-প্রসেসিং – ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও ব্র্যান্ডিং-এ নারীদের সম্পৃক্ত করা।
4. নারীবান্ধব কৃষি যন্ত্রপাতি – হালকা ও সহজ ব্যবহারযোগ্য যন্ত্র তৈরি ও সরবরাহ।
মাঠ পর্যায়ের সাফল্যের গল্প
কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার নারী কৃষক হাসিনা আক্তার গত মৌসুমে কৃষি সম্প্রসারণ সেবা থেকে সবজি চাষের প্রশিক্ষণ নেন। নতুন কৌশল ব্যবহার করে তিনি জমির উৎপাদন দ্বিগুণ করতে সক্ষম হন।
“আগে শুধু পরিবারের জন্য সবজি ফলাতাম, এখন বাজারে বিক্রি করে মাসে ৭-৮ হাজার টাকা আয় করি।”
চ্যালেঞ্জ
• সামাজিক বিধিনিষেধ – অনেক পরিবার নারীদের মাঠে বা প্রশিক্ষণে পাঠাতে অনিচ্ছুক।
• ভূমি মালিকানার অভাব – জমির মালিকানা না থাকায় অনেক নারী কৃষি ঋণ পান না।
• তথ্যের সীমাবদ্ধতা – প্রযুক্তি বা বাজার সংক্রান্ত তথ্য সময়মতো হাতে পৌঁছায় না।
• পর্যাপ্ত নারী কৃষি কর্মকর্তা না থাকা – মাঠ পর্যায়ে নারী কৃষি কর্মকর্তার সংখ্যা কম হওয়ায় নারী কৃষকদের সেবা সীমিত।
বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ
1. নারীবান্ধব সম্প্রসারণ নীতি প্রণয়ন।
2. নারী কৃষকের জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ।
3. নারী প্রশিক্ষক ও কৃষি কর্মকর্তার সংখ্যা বৃদ্ধি।
4. বাজারে নারী কৃষকের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
পরিশেষে, নারী কৃষকদের ক্ষমতায়ন শুধু তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, বরং বাংলাদেশের সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কৃষি সম্প্রসারণ সেবা যদি পরিকল্পিতভাবে নারীবান্ধব করা যায়, তাহলে আগামী দিনে গ্রামীণ অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে এবং লাখো নারী কৃষক আত্মনির্ভরশীলতার পথে এগিয়ে যাবেন।