শাহজাদপুর চৌকি আদালতের একজন বিচারকের নাম ভাঙিয়ে ভয়াবহ প্রতারণার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন রফিক নামের একজন চায়ের দোকানদার। ক্রমেই বেরিয়ে আসছে তার প্রতারণার আরও চিত্র।
জানা যায়, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর পৌর এলাকার উপজেলা পরিষদ চত্বরে অবস্থিত শাহজাদপুর চৌকি আদালত। এই আদালতের সামনেই একটি টং দোকানে চা বিক্রি করেন যুবক রফিক। চায়ের পাশাপাশি তিনি খাবারও বিক্রি করে থাকেন। নিয়মিত তিনি চৌকি আদালতের বিচারকদের খাবার সরবরাহ করে থাকেন।নিয়মিত বিচারকদের খাবার সরবরাহের পাশাপাশি তাদের বিভিন্ন কাজ করার বিষয়টি কে পুঁজি করে রফিক তাদের নাম ভাঙিয়ে বিচার প্রার্থীদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
সোমবার (১লা জুলাই) আদালত চত্বরে এরকমই একজন ভুক্তভোগী সুশীল কুমার ঘোষের সাথে কথা হয়। উপজেলার বেলতৈল ইউনিয়নের বেলতৈল গ্রামের প্রতিবন্ধী বৃদ্ধ সুশীল কুমার ঘোষ (৭৯), এই আদালতে জমি সংক্রান্ত তার একটি মামলা ছিল। সুশীল কুমার বিয়ে না করায় তার স্ত্রী সন্তান কেউ নেই, বর্তমানে তিনি একাই জীবন যাপন করছেন। ধার দেনা করে খেয়ে না খেয়ে তিনি মামলার খরচ বহন করেন।তিনি অভিযোগ করে বলেন, প্রায় ১ বছর পূর্বে তার মামলাটি খারিজ করে দেন আদালত। তখনই রফিকের নজরে পরেন তিনি, রফিক যুগ্ম দায়রা জজ আদালতের বিচারক মামুন অর রশিদ এর মাধ্যমে মামলার রায় তার অনুকূলে দেয়ার আশ্বাস দেন। দিশেহারা প্রতিবন্ধী বৃদ্ধ সুশীল কুমার তখনও রফিকের ফাঁদে পা দেননি।
পরে সুশীল কুমারের বিশ্বাস অর্জনের জন্য কোন এক ব্যক্তিকে শাহজাদপুর যুগ্ম ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মামুন অর রশিদ সাজিয়ে মুঠোফোনে কথা বলিয় দেন। তারপর থেকে প্রতিনিয়ত মামলার খরচ ও কাগজপত্র সংগ্রহের নাম করে বৃদ্ধ সুশীল কুমারের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিতে থাকেন রফিক। বৌয়ের শাড়ি, ছেলেমেয়েদের পোষাক ও বাড়ির বাজার সদাই ও তাকে দিয়ে ক্রয় করে নিতেন। সময় যতো গড়াতে থাকে ভুয়া বিচারক সাজিয়ে কথা বলে রফিকের প্রতারণার মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে।এভাবে নিয়ে প্রায় দেড় লাখ টাকা রফিক হাতিয়ে নিয়েছে, এক পর্যায়ে বৃদ্ধ সুশীল কুমার বুঝতে পারেন যে তিনি প্রতারিত হচ্ছেন। এরই মধ্যে রফিকের প্রতারণার ফাঁদে জড়িয়ে জায়গা সংক্রান্ত ঝামেলা গুলো তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায় তার, প্রতিপক্ষের লোকজন তার জায়গা জমি দখল করে নেয় এবং বেশকয়েকটি গাছও কেটে নেয়।
পরে তিনি প্রতারক রফিকের কাছে মামলার কাগজপত্র ফেরত চাইলে সে নানারকম টালবাহানা করতে থাকে। প্রতিবেশী একজনের মাধ্যমে তিনি নালিশ জানান রফিকের চায়ের দোকানের পাশের বিআরডিবি'র চেয়ারম্যান লূৎফর রহমানের কাছে। তিনি রফিকের কাছ থেকে সুশীল কুমারের কাগজপত্র ফেরত চাইলে আবারও খরচ বাবদ ১৫ হাজার টাকা দাবি করে সে। পরবর্তীতে লূৎফর রহমানের মাধ্যমে রফিককে আরও ১৫ হাজার টাকা প্রদান করা হয়।সুশীল কুমার এই প্রতিনিধির কাছে অভিযোগ করে বলেন, প্রতারণার মাধ্যমে রফিক তার কাছ থেকে এখন পর্যন্ত দেড় লাখ টাকা নিয়েছেন। তিনি টাকাও ফেরত দিচ্ছে না কাগজপত্রও ফেরত দিচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চা দোকানদার রফিক একজন নেশাগ্রস্থ। সে দীর্ঘদিন যাবৎ বিভিন্ন ভাবে প্রতারণার মাধ্যমে বিচার প্রার্থীদের ঠেকাচ্ছেন। এমনকি আদালতে চাকরি দেওয়ার নাম করেও মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে চলেছেন।এই বিষয়ে বিআরডিবি'র চেয়ারম্যান লূৎফর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আমি চেষ্টা করেছি রফিকের কাছ থেকে টাকা ও কাগজপত্র তুলে দেয়ার জন্য। সে আমার মাধ্যমেও খরচের টাকা নিয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্ত ফেরত দেয়নি।
এই বিষয়ে শাহজাদপুর আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এড. শেখ আব্দুল হামিদ লাভলু বলেন, একজন চা দোকানদার হয়ে বিচারপ্রার্থীদের সাথে প্রতারণা একটি গর্হিত কাজ। এছাড়া তার এই প্রতারণার কারণে অনেক মানুষ আদালতের সাহায্য ও বিচার বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি রফিকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।এই বিষয়ে অভিযুক্ত চায়ের দোকানদার রফিকের বক্তব্য জানতে তার দোকানে গেলে সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে সে পালিয়ে যায়। পরে তার স্ত্রীর কাছে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি ১০ হাজার টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করেন।
এর আগে গোপনে অভিযুক্ত রফিকের সাথে কথা বললে সে জানায়, আমার ভুল হয়েছে আমাকে মাফ করে দিন। বিচারক পরিচয়ে সুশীল কুমারের সাথে কে কথা বলেছে জিজ্ঞাসা করলে সে এড়িয়ে যায়। আরও কয়েকজনের কাছ থেকে প্রতারণা করে টাকা নেয়ার অভিযোগও স্বীকার করেন।পরে এই প্রতারণার বিষয়ে শাহজাদপুর যুগ্ম দায়রা জজ আদালতের বিচারক মামুন অর রশিদকে অবহিত করা হয়।প্রতারণার ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়লে শাহজাদপুর চৌকি আদালত চত্বরে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এসময় উকিল, মহুরী ও বিচারপ্রার্থীরা প্রতারক রফিকের শাস্তি দাবি করেন।