শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডের টয়লেটের পাইপ ভেঙে শনিবার সদ্যোজাত সন্তানকে উদ্ধার করেছেন তার বাবা।

বলা হচ্ছে, প্রসবের অপেক্ষায় থাকা এক নারী টয়লেটে গেলে সেখানেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। এরপর সেই সন্তান টয়লেটের পাইপ দিয়ে বেশ কিছুটা সামনে গিয়ে আটকে যায়। সেই পাইপ ভেঙেই জীবন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় শিশুটিকে।

টয়লেটে ভূমিষ্ঠ হওয়া কোনো শিশু কী করে পাইপের ভেতরে গেল এবং তাকে কী করে জীবন্ত উদ্ধার করা সম্ভব হলো তা অনুসন্ধান করেছে 

শিশুর বাবা নেয়ামত উল্লাহ সোমবার  জানান, তাদের বাড়ি পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠির গণমান শেখপাড়া বাজার এলাকায়। তিনি পেশায় জেলে ও তার স্ত্রী শিল্পী বেগম গৃহিণী। তাদের আগে একটি চার বছরের মেয়ে আছে। স্ত্রীর দ্বিতীয় সন্তান প্রসবের প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হলে শ‌নিবার সকাল ৮টার দিকে তাকে বরিশাল মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়।

নেয়ামত বলেন, ‘দুপুরে ডাক্তার সিজার করার কথা কইলে আমি ওষুধ কিনতে যাই। ২টার কিছু পর আইসা দেখি টয়‌লে‌টের সাম‌নে ভিড়। তারপর কয়েকজন কইল আমার স্ত্রী পায়খানা করতে গিয়া টয়লেটেই বাচ্চা জন্ম দিছে। সেই বাচ্চা টয়লেটের মধ্যে পইড়া গেছে।

‘ভিতরে ঢুইকা দেখি রক্তে মাখা। সবাই কইতে আছিল বাচ্চা মারা গেছে। আমি প্যানের পাইপের মধ্যে হাত ঢুকাইয়া কিছু পাই না। এরপর কান্নার শব্দ পাইয়া পাগলের মতো দুই তলার শিশু ওয়ার্ডে যাই। সেইখানের ছাদের নিচের পাইপ ভাইঙ্গা আমার মাইয়াটারে বাইর কইরা ডাক্তারের কাছে নেই।’


ঘটনার সময় বরিশাল মেডিক্যালের তৃতীয় তলার প্রসূতি ওয়ার্ডে থাকা কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা।

প্রসূতি ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্নতাকর্মী সাপিয়া বানু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সন্ধ্যা ৬টায় ওই রোগীর সিজার করার কথা ছিল। বিকেল ৪টার সময় উনি বলছেন, ওনার বাথরুম লাগছে। তারপর বাথরুমে গেছেন। পাঁচ মিনিটমতো ভেতরে ছিলেন। বের হইয়া বলেন, টয়লেটের পানির সঙ্গে ওনার বাইচ্চা ভাইসা গেছে।

‘তারপর আমাদের ডাকছে। আমরা দৌড়াইয়া যাইয়া হাত দিছি। আমি অনেক দূর পর্যন্ত ডান হাত ঢুকাইছি। ডান কান পাইতা কান্নার শব্দ পাইছি।’

এই ওয়ার্ডের অফিস সহায়ক জেসমিন আক্তার বলেন, ‘আমরা একজনের কাছে শুনি বাথরুমে বাচ্চা পইড়া গেছে। যাইয়া দেখি রোগী বেডে শোয়া। আমাদের এক খালা আছে, ওই খালা প্যানের ভেতরে অনেকখানি হাত ঢুকাই দেছে। প্রায় পুরা হাতই। তাও বাচ্চা পাওয়া যাইতেছে না, খালি কান্না করতাছে।

‘এরপর আমি ওয়ার্ড মাস্টারের কাছে ফোন দিছি। তিনি স্যানিটারি মিস্ত্রিরে ফোন দেছেন। সে ২০ মিনিটে গাড়ি রিজার্ভ কইরা আইসা পড়ছে। সেও কান্না শুনছে। যে বরাবর কান্না শুনছে সেই বরাবর পাইপ ভাঙছে। তয় বাচ্চাটার বাবাই মূলত ওরে বাইর করছে।’

শিশুটিকে উদ্ধারের সময় উপস্থিত ছিলেন হাসপাতালের স্বেচ্ছাসেবক আব্দুল জলিল।

তিনি বলেন, ‘আমরা শুইনা দৌড়াইয়া তিন তলায় গেছি। হাত দিয়া বাচ্চা পাওয়া যাইতেছে না কিন্তু কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাইতেছে। এরপর আমরা দোতলায় আসি। হাতুড় আর ছেনি দিয়া পাইপের মাঝখানে ভাঙছে। মাঝখানে পাওয়া যাইল না। এরপর দক্ষিণ সাইডে পাইপ ভাইঙ্গা দেখি বাচ্চার পা।

‘তখন বাচ্চার বাবাও লাফ দিয়া টেবিলের ওপর উঠছে। লগে লগে পাইপ ভাইঙ্গা আমরা বাচ্চাটারে উদ্ধার করছি।’


প্রসূতি ওয়ার্ডের ওই টয়লেটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনো কমোড নেই, প্যান বসানো আছে। প্যানের পাইপের মুখের ব্যাস ছয় ইঞ্চি। আর সদ্যোজাত শিশুর বাম থেকে ডান কাঁধ পর্যন্ত চওড়া প্রায় সাড়ে চার ইঞ্চি।

টয়লেটের পাইপটি তিন তলা থেকে সোজা নেমে গেছে দোতলায় শিশু ওয়ার্ডে। শিশু ওয়ার্ডের ছাদের নিচ দিয়ে পাইপটি পুবদিকের দেয়ালের দিকে গিয়ে ৯০ ডিগ্রি কোণে বাঁক নিয়েছে। এরপর সেটি উত্তর দিকে খানিকটা এগিয়ে বামে আবার বেঁকে আরেক পাশের দেয়াল বরাবর চলে গেছে। উত্তর দিকের পাইপে পাঁচ ফুটের বেশি দূরত্বে শিশুটিকে পাওয়া যায়।


একটি সদ্যোজাত শিশু ৬ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপের ভেতর পড়তে পারে কি না সে বিষয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মী সাপিয়া বলেন, ‘অনেক ছোট হলে বাচ্চা পড়তে পারে। ওই বাচ্চাটির ওজন মাত্র দেড় কেজি। দেড় কেজি বইলাই পইড়া গেছে। গায়ে কোনো গোশত নাই। শুকনা একদম। ওই জন্যই বাচ্চাটা পড়ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাথরুমের ট্যাপ ছাড়া ছিল। পাইপটাও মোটা। পানির লগে (শিশুটি) নাইমা গেছে।’

এর আগেও টয়লেটে বাচ্চা প্রসবের ঘটনা ঘটেছে বলে জানান সাপিয়া। তবে তা হাসপাতালের মেঝেতে বা দরজায়। প্যানে পড়ে যাওয়ার ঘটনা ২২ বছরের কর্মজীবনে এই প্রথম দেখলেন তিনি।

স্বেচ্ছাসেবক আব্দুল জলিল জানান, পাইপের যেখান থেকে উদ্ধার করা হয় সেই অংশে কোনো পানি জমে ছিল না।

তিনি বলেন, ‘বাচ্চা শুইয়া রইছে। হের পরও পাইপের ওপরে ফাঁকা রইছে। বাচ্চা শুইয়া পাও লাড়াইতেছিল তাও ফাঁকা রইছে।’

উদ্ধারের পর শিশুটির নাভির সঙ্গে প্রায় দুই ইঞ্চির মতো আমব্লিক্যাল কর্ড (নাভি রজ্জু) যুক্ত ছিল। দ্রুত তাকে পরিচ্ছন্ন করে অক্সিজেন দেয়া হয়।


বরিশাল মেডিক্যালের শিশু বিভা‌গের প্রধান মু‌জিবুর রহমান বলেন, ‘বাচ্চাটি অপরিণত। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই প্রসব হয়েছে। স্বাভাবিক বাচ্চার ওজন প্রায় আড়াই কেজি হয়। এই বাচ্চার ওজন ১ কেজি ৩০০ গ্রাম। শিশুদের বিশেষ সেবা ইউনিটে (স্ক্যানু) তার চিকিৎসা চলছে। এমনিতে তার সব ঠিকঠাক আছে। কোনো সমস্যা দেখা যাচ্ছে না।’

পাইপে প্রায় দুই ঘণ্টা আবদ্ধ সদ্যোজাত শিশুর জীবিত থাকার বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক এইচ এম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘নবজাতকটি হয়তো কোনোভাবে অক্সিজেন পেয়েছে। সে কারণে বেঁচে ছিল।’