জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি প্রতিনিয়ত নতুন মাত্রা নিচ্ছে। আর এই সংকটের মুখে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। বনভূমি হ্রাস, কৃষি উৎপাদনে বিঘ্ন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি – সবকিছু মিলিয়ে পরিবেশ রক্ষায় এখন সময়োপযোগী ও সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারের পাশাপাশি এগিয়ে আসছে বেসরকারি খাতও। বৃক্ষরোপণ ও সবুজায়নে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে, যা পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলায় এক নতুন আশার দিগন্ত উন্মোচন করছে।
গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের তুলনায় দ্রুত হারে বনভূমি হারাচ্ছে বাংলাদেশ। ২০০২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশে বনভূমির পরিমাণ কমেছে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, যেখানে একই সময়ে সারা বিশ্বে বনভূমি কমেছে গড়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। বনভূমি কমার এই হার বেশ উদ্বেগজনক। কারণ এটি ত্বরান্বিত করছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাকে। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে যার ক্ষতির প্রভাব সরাসরি পড়ে দেশের পরিবেশ, কৃষি ও অর্থনীতিতে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৩৪০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। যেখানে দেশের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে কৃষির ওপর নির্ভর করে, সেখানে এমন সংকট জীবন-জীবিকার পথে বড় বাধা সৃষ্টি করছে । ফলে পরিবেশ রক্ষায় বনায়ন ও বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম এখন আর কেবল প্রকৃতি সংরক্ষণের কাজ নয়, বরং এটি দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সবুজায়নের গুরুত্ব বুঝে বেসরকারি খাত থেকে নেওয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। এসব উদ্যোগ সাধারণ মানুষের বেশ প্রশংসাও কুড়াচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী প্রিয়াংশু পোদ্দার বলেন, ‘বর্তমান জলবায়ু সংকটের প্রেক্ষাপটে বৃক্ষরোপণ শুধু পরিবেশ রক্ষার মাধ্যম নয়, এটি আমাদের টিকে থাকার লড়াইয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। আমরা নিজেরাই যদি সচেতন না হই, তাহলে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে পারবো না।‘ তিনি বলেন, ’গত বছর পূবালী ব্যাংক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কর্মসূচির আওতায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির আয়োজন করে। ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের সার্বিক তত্ত্বাবধানে আয়োজিত এই কর্মসূচিতে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের প্রাঙ্গণে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা রোপণ করা হয়। এ ধরনের উদ্যোগ শুধু ক্যাম্পাসকেই সবুজ করে না, আমাদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখে। এমন কর্মকাণ্ডে আমাদের মত শিক্ষার্থীরাও অনুপ্রাণিত হয় এবং ভবিষ্যতে আরও বৃহৎ পরিসরে অংশ নেওয়ার আগ্রহ জন্মায়।‘
ঢাকার বাইরেও বেসরকারি কোম্পানির বৃক্ষরোপণ কার্যক্রমে ব্যাপক উৎসাহ দেখা গেছে। সেখানে ২০২৪ সালে লোটো বাংলাদেশ গাজীপুরে পরিবেশ রক্ষা ও সামাজিক কল্যাণে অবদান রাখার লক্ষ্যে একটি বৃহৎ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির আয়োজন করে। প্রতিষ্ঠানটি দেশের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার উদ্দেশ্যে সারাদেশে প্রায় ১৮ হাজার গাছ লাগানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। এর অংশ হিসেবে গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একযোগে বৃক্ষরোপণে অংশ নেয় কোম্পানিটির প্রতিনিধিরা। একই দিনে সরকারি অফিস, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও নির্ধারিত স্থানে গাছের চারা রোপণ করা হয়। স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ও উৎসাহে এই কর্মসূচি একটি সফল পরিবেশগত উদ্যোগে পরিণত হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশে সবুজায়নের প্রচেষ্টাকে কার্যকর করে তুলতে ৪৫ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে বিএটি বাংলাদেশ। তাদের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বর্তমানে শুধু পরিবেশ রক্ষার একটি উদ্যোগ নয়, বরং অনেকের জীবিকার উৎসও হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোম্পানিটি একটি সবুজায়ন কর্মসূচি চালু করে, যার লক্ষ্য ছিল পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখা। কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ কর্মসূচির আওতায় লাখ লাখ চারা বিনামূল্যে বিতরণ ও রোপণ করা হয়। এর ফলে কৃষকরা যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন, তেমনি স্থানীয় পরিবেশও হয়ে উঠছে সবুজ ও টেকসই।
এ কর্মসূচির সফলতার বাস্তব উদাহরণ হলেন শিমুলিয়া গ্রামের জয়নাল আবেদীন। ২০০৩ সালে তিনি বনায়ন কর্মসূচির একটি কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন এবং সেখান থেকে ৬ হাজার মেহগনি গাছের চারা সংগ্রহ করেন। পরবর্তীতে এই চারা বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেন তিনি। জয়নালের মত শত শত মানুষ বনায়ন কর্মসূচির মাধ্যমে শুধু আর্থিক সচ্ছলতাই অর্জন করেননি, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও অংশ নিয়েছেন।
পরিবেশবিদদের মতে, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় বৃক্ষরোপণ একটি কার্যকর উদ্যোগ। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এমন উদ্যোগে মানুষের উৎসাহব্যঞ্জক অংশগ্রহণ দেশের সবুজায়ন ও টেকসই উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক। দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোও এমন উদ্যোগ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরিবেশ রক্ষায় কাজ করে গেলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করে দেশের কৃষি ও অর্থনীতির জন্য আরও কার্যকরী ভূমিকা পালন করা সম্ভব হবে।