সুনামগঞ্জ—সিলেট মহাসড়কে চলছে মগের মুল্লুক। নিয়মের বাইরে গিয়ে যেমন খুশি তেমন সাজোর মতো, যেখানে ইচ্ছা সেখানেই চলছে ইচ্ছে মত গতিরোধক নির্মাণ। অপ্রশস্ত অতিরিক্ত উঁচু এসব গতিরোধক নির্মাণে নেই কোন স্ট্যান্ডার্ড ডিজাইন। যার কারণে যানবাহনের গতি রোধের চেয়ে দুর্ঘটনা ঘটার ঝুঁকি বেশী। অতিরিক্ত উচ্চতার কিছু দূর—দূর স্থাপিত গতিরোধক চালকদের বিরক্তি ও যানবাহনের পার্টস দ্রুত ক্ষতি হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ যাত্রী। অতিরিক্ত উচ্চতার অপরিকল্পিত গতিরোধকের ঝাঁকুনির কারণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। হাড় ভাঙা রোগী কিংবা প্রসুতি রোগীকে নিয়ে পারাপারের সময় বড় ঝাঁকুনির কারণে যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে বেশি।
জানা যায়, ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে স্পিড ব্রেকার অপসারণের একটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সড়ক বিভাগের ১০টি জোনে এক হাজার ১৮৮টি স্পিড ব্রেকার ছিল। যার মধ্যে ৭৫৫টি স্পিড ব্রেকার অপসারণ করা হয়। এর আগে অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে মহাসড়ক থেকে অপ্রয়োজনীয় স্পিড ব্রেকার তুলে দেওয়ার সুপারিশ করে সংসদীয় কমিটি।
অথচ সুনামগঞ্জে স্পিড ব্রেকার কমানোর পরিবর্তে দিন দিন শুধু বাড়ানো হচ্ছে। স¤প্রতি বিজিবি ক্যাম্পের সামনে নতুন স্থাপিত দুটি অতিরিক্ত উচ্চতার গতিরোধক নিয়ে শহরে চলছে ব্যাপক সমালোচনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কতৃর্পক্ষকে তুলোধুনো করছেন নেটিজনেরা। উচ্চতা বেশী হওয়ায় এই স্পিড ব্রেকার পার হতে সময় বেশি লাগে তাই নিয়মিত জ্যাম লেগে থাকে। এ নিয়ে সড়ক ও জনপথ অফিসের সামনে থেকে পৌর কলেজের সামনে পর্যন্ত ৩.৭ কিলোমিটার সড়কে ১২ টি স্পিড ব্রেকার নির্মাণ করা হয়েছে। সড়ক ও জনপথের সামনে ১টি, পিটি আই স্কুলের সামনে ২টি, নতুন কোর্টের সামনে ২ টি, টেকনিক্যাল স্কুলের সামনে ১টি, সার্কিট হাউজের সামনে ২ টি, বিজিবি ক্যাম্পের সামনে ২টি, এলজিডির সামনে ১টি ও পৌর কলেজের সামনে ১টি। অথচ নিয়ম হচ্ছে মহাসড়কে কোন গতিরোধক স্থাপন করা যাবে না। নিয়মের বাইরে গিয়ে স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী এসব স্পিড ব্রেকার নির্মাণ করেছে সওজ।
বিজিবি গেটের সামনে নতুন নির্মিত স্পিড ব্রেকারের ছবি তোলার সময় গাড়ি থামিয়ে এক চালক ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, সুনামগঞ্জের সড়ক দেখার যেন কেউ নাই। যেখানে ইচ্ছা যেমন ইচ্ছা স্পিড ব্রেকার নির্মাণ করে দুর্ভোগ বাড়ানো হচ্ছে। যেখানে প্রয়োজন সেখানে স্পিড ব্রেকার নির্মাণ হোক, কিন্তু সেটা যেন সড়কের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কম উচ্চতা ও প্রশস্ত হয়। অতিরিক্ত উচ্চতা হলে গাড়ি দ্রুত নষ্ট হয়। মোটরসাইকেল আরোহী আবুল হাসান বলেন, এই স্পিড ব্রেকার এতো উঁচু যে পেছনে একজন নিয়ে গেলে নীচের স্ট্যান্ড লেগে যায়। এতে যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটবে এবং গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাছাড়া জরুরী প্রসূতি মাকে এই ব্রেকারের উপর দিয়ে নিয়ে গেলে যে ঝাঁকুনি লাগবে, গাড়ির ভেতরেই হয়তো দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। হাড় ভাঙা রোগী হলে ভাঙার সময়ের চেয়েও বেশী কষ্ট হবে। সাংবাদিক দেওয়ান গিয়াস চৌধুরী বলেন, সুনামগঞ্জের সড়কে মগের মুল্লুক চলছে। একটু পর পর স্পিড ব্রেকার এটার কোন মানে আছে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দুই মিনিটের রাস্তায় ৮টি স্পিড ব্রেকার পার হতে হয়। এটি অত্যন্ত বিরক্তিকর। স্পিড ব্রেকার দিতেই যদি হয় সেটা একটা স্ট্যান্ডার্ড মেনে নিয়ম নীতির ভেতরে পরিকল্পনা করে নির্মাণ করা হউক। দুর্ঘটনার ঝুঁকি রোধে অতিরিক্ত উচ্চতায় স্থাপিত ব্রেকারগুলো অপসারণ করতে হবে। সুনামগঞ্জের বিশিষ্ট চিকিৎসক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অতনু ভট্টাচার্য সম্প্রতি দৈনিক সুনামগঞ্জের খবরে লিখেছেন, “স্পীড ব্রেকার নাকি কোমর ব্রেকার” তাঁর লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে, স্পিড ব্রেকারের আদর্শ উচ্চতা এবং দৈর্ঘ্য এমনভাবে ডিজাইন করা উচিত, যাতে এটি যানবাহনগুলোকে সঠিকভাবে ধীরগতি করতে পারে এবং একইসাথে ড্রাইভার ও যাত্রীদের জন্য নিরাপত্তা এবং আরাম নিশ্চিত করতে পারে। স্পিড ব্রেকার এর লক্ষ্য হলো, গতি কমানোর কার্যকারিতা এবং ট্রাফিক প্রবাহে কম বিঘ্ন ঘটানোর মধ্যে একটি সুষম ভারসাম্য বজায় রাখা। বৈজ্ঞানিকভাবে না বানানো বা খারাপভাবে তৈরি স্পিড ব্রেকারগুলি মানুষের মেরুদণ্ডে উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষত যখন সেগুলি খুব উঁচু, খুব তীক্ষè বা ভুল আকারে হয়। যখন যানবাহনগুলি এমন স্পিড ব্রেকার পার হয়ে যায়, তখন যাত্রীরা এবং চালকরা আকস্মিক ঝাঁকুনি এবং কম্পন অনুভব করেন। এই তীব্র শক্তি মেরুদণ্ডে বিশেষ করে নীচের পিঠ এবং গলায় চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যা অস্বস্তি, ব্যথা এবং এমনকি দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি ঘটাতে পারে। একাধিকবার এই ধরনের প্রভাবের সম্মুখীন হলে মেরুদণ্ডের হাড়ের ফাঁকে অবস্থিত ডিস্ক এর ক্ষয়জনিত সমস্যা, মাংসপেশির শক্ত হয়ে যাওয়া এবং জয়েন্টের সমস্যা হতে পারে। এছাড়াও ভুলভাবে ডিজাইন করা স্পিড ব্রেকারগুলিতে গাড়ি লাফিয়ে উঠতে পারে, যার কারণে চালক দ্রুত ব্রেকিং করতে পারেন এবং এতে মেরুদণ্ডে তীব্র আঘাতের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। অতএব স্পিড ব্রেকারগুলি বৈজ্ঞানিকভাবে ডিজাইন করা উচিত যাতে মানবদেহে চাপ কমানো যায় এবং মসৃণ, নিয়ন্ত্রিত গতিরোধ নিশ্চিত হয়। বৈজ্ঞানিকভাবে ডিজাইন করা স্পিড বাম্প এবং স্পিড হামপের নির্দিষ্ট মাপ থাকে, যা যানবাহনকে কার্যকরভাবে ধীরগতি করতে সাহায্য করে এবং যাত্রী ও যানবাহনের ক্ষতি বা অস্বস্তি কমায়। এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী আহাদ উল্লাহ বলেন, আইন অনুযায়ী মহাসড়কে স্পীড ব্রেকার নির্মাণ করা যায় না। আইনে না থাকলেও স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী আমরা করে দেই। একইভাবে বিজিবির আবেদনের প্রেক্ষিতে তাদের গেইটের সামনে নির্মাণ করা হয়েছে। এতো উঁচু ও অপ্রশস্ত কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিজিবি নিজে দাড়িয়ে থেকে এটা করেছে উঁচু করে। নিয়মের বাইরে গিয়ে বিজিবির কথা মতো স্পিড ব্রেকার বানিয়ে মানুষকে দুর্ভোগে ফেলা যায় কি না, জানতে চাইলে বিজিবির সাথে কথা বলে এটা নিচু করার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান তিনি।